Beder Kormi

বেদের কর্মী

শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫

বালক ব্রহ্মচারী মহারাজ এর বাণী।

রাম নারায়ণ রাম জীবনে চলার পথে সাড়াটা যে পাচ্ছ, এই যে সজাগ — সে সারাক্ষণ সজাগ হয়েই রয়েছে। এই সজাগ হ'তে যা-ই আসে তার শেষ নাই। *************************** মহাশূন্যে ঝড় বৃষ্টি কত কি হচ্ছে, তার শেষ নাই। সূর্যের আলো, তার শেষ নাই। সেইজন্যে তোমাদের মধ্যে যে মনটা আছে, তারও শেষ নাই। কারণ সেও তো সজাগ হতেই এসেছে। সেও বিরাট। তাই বলছি, সজাগ হতে যা-ই আসে, তারই শেষ নাই। এতটুকু উদর ওটাকেই ভরতে পারছো না। সকালে খেলে তো বিকালে ক্ষুধা। কত বছর হ'য়ে গেল , এটার সেবা তো কম করলে না। তুমি মনে করলে খেয়ে এসে , আর জীবনে খাব না। কিন্তু আবার ক্ষুধা। সুতরাং তুমি এটাই ভরাতে পারছো না। শুধু এইটা কেন , কোন্ ইন্দ্রিয়ের কোন্ টা সামাল দিতে পেরেছ ? চোখে দেখে , কানে শুনে , কোন্ ইন্দ্রিয়ের কোনটাই শেষ করতে পারছো না। শেষ করলে কি করে হবে ? যেখান থেকে এসেছ , তোমাদের হাবে-ভাবে , চাল-চলনে , কথায়- বার্তায় সেই রকমই তো হবে। আম গাছের বীজ থেকে আম আর কাঁঠাল গাছের বীজ থেকে কাঁঠালই হবে। একটা কাঁঠালের বীচি দেখলে কি ফলটা বুঝা যায় ? যারা কাঁঠাল কখনো দেখে নাই , তারা বুঝবে ! বুঝবে কখন ? যখন মাটিতে পুঁতে দেবে। বীজ পুঁতে দিলে , কাঁঠাল গাছ হ'ল। সারা গায়ে কাঁঠাল হ'ল। তারপর আবার আঠা। আমাদের ভিতরেও সেই বীজ আছে। সজাগ যখন আছে , তার সাড়াটা তো আছে। এই সাড়াটাই হ'চ্ছে সজাগ , সমস্ত সৃষ্টিকার্যের ধারাবাহিকতা যে রক্ষা করছে। শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গের কোনটারই শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। হাতকে জিজ্ঞাসা করো — তুমি কি করলে ? হাত বলে , আমি ঠেলা দিয়ে জিহ্বায় পাঠিয়েছি। জিহ্বারে জিজ্ঞাসা করো , সে বলে — আমি জানিনা। আমি শুধু যাদের আমার ভিতরে পাই , এধার-ওধার গুঁড়া করি। আমার কাজ শেষ। তারপর এল উদরে। এসে নানা রকমে হজম চলছে। বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন মুখী হ'য়ে যে যার কাজ ক'রে চলেছে। কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করো , রক্ত হ'ল কি করে ? মল-মূত্র হ'ল কি করে ? কেউ বলতে পারবে না। কাউকে খুঁজে পাবে না। কোন্ দিকে কি চলছে , তবে চলছে , এটা ঠিক। অদ্ভুত চাল-চলন , হ‍্যানে-ত‍্যানে তার মধ‍্যে হ'তে এখান দিয়ে কথা বলি , এখান দিয়ে শুনি। তবে কে বলে , কোথা থেকে বলে — খুঁজে পাওয়া যাবে না। খালি বলবে , এখান থেকে এই শিরা দিয়ে রক্ত আঙ্গুলে আসে। তারপর এখান থেকে সেখান যায়। এখানে মগজ আছে , এখানে ঘিলু আছে — এসব কথা ডাক্তারের ন‍্যায়। এখানে ধাক্কা খেলে resound হয় , vibration হয়। এই হয় , ওই হয় করছে। কিন্তু বুঝলো কেটা ? সেটাই খুঁজে পাওয়া যায় না। অদ্ভুত তো সেটাই ! ... চোখ পকেটে নিয়ে যাচ্ছে। আর একজনকে লাগিয়ে দিচ্ছে , সে দেখছে। এ তো আগেও ছিল। আগে চোখ হাতে করে নিয়ে আসতো। এই চোখ তো দেখে না। দেখে কেটা ? বাপের চক্ষুটা পোলারে দিয়েছে , সে দেখছে। তাহলে দেখা যায় , একজনের চোখ আরেকজনকে লাগিয়ে দিলে দেখতে পারে। দেখ , একটা Bulb লাগিয়ে দিলে তো জ্বলে ! জীবনে চলার পথে সাড়াটা যে পাচ্ছ , এই যে সজাগ — সে সারাক্ষণ সজাগ হয়েই রয়েছে। ... গামলাতে মাংস কেটে রেখেছে , মাংস তখনও নড়ছে। হলুদ , মরিচ দিয়ে মেখেছে তবুও এমনি এমনি করছে। প্রাণের যে গতি , তখনও সাড়াটা তার মধ‍্যে খেলছে। তাহলে এটাকে জীবন বলবে , না সাড়া বলবে ? জম্মসিদ্ধ মহান শ্রী শ্রী বালক ব্রম্মচারী মহারাজ। পুস্তক সূত্র : সুরস্রষ্টা শিবশম্ভু। রাম নারায়ণ রাম Ram narayan ram balak brahmachari maharaj

Ram Narayan Ram, বালক ব্রহ্মচারী মহারাজ কি এ যুগের যুগ ত্রেতা?

রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৪

তোমরা আগে বুঝবে , উপলদ্ধি করবে , তারপর গ্ৰহণ করবে। ************************************** দেব দেবতারাতো সেদিনকার। পাঁচ হাজার , সাত হাজার , দশ হাজার বছরের। ....পঞ্চাশ হাজার বছর আগে যে মানুষ ছিল তখন দেবতা কে ছিল ? সুর ছিল। তাই আজ্ঞাচক্রে সহস্রারে শিবশক্তি দেখতে পাচ্ছ , প্রকৃতি-পুরুষ। তোমরা কি করবে ? দেবর্ষি নারদ শিবের কাছে গেলেন। শিব তখন বললেন , মহাকাশের ধ্বনির সাথে যুক্ত হও। তোমরা মনে মনে করবে জপ , আর সময় মতো সেই সুর বাজাবে। মূলাধার , স্বাধিষ্ঠান , মণিপুর কিন্তু তোমাদের দীক্ষা দিয়েছি সহস্রারে , অনেক ঊর্দ্ধে। অনেক বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানা। প্রত‍্যেক দ্বারের একটা অনুভূতি আছে। 'সা' -এর টিপ দিলে একরকম শব্দ হয়, 'রে'-এর মধ‍্যে টিপ দিলে আরএক রকমের শব্দ হয়। এই হারমণিটা তোমরা বাজাবে। শুধু সুরে থাকবে। "রাম নারায়ণ রাম" আপনমনে ব'সে ব'সে জপ করতে থাকবে‌। "হে সুর ! কে তুমি জানিনা , কোথায় আছো জানিনা , কিন্তু চলছে জগতের সৃষ্টি। সৃষ্টির আরম্ভ কোথায় জানি না। মহাকাশের মহা নিনাদ সুরে আনলে , নিশ্চয়ই তোমার সুর খুঁজে পাবো। তোমরা সেই আশীর্বাদ কর, সেই সুর সাধাতে যেন ডুবে থাকতে পারি।" তোমরা আগে বুঝবে , উপলদ্ধি করবে , তারপর গ্ৰহণ করবে। জম্মসিদ্ধ মহান শ্রী শ্রী বালক ব্রম্মচারী মহারাজ। পুস্তক সূত্র : অমৃত। 🙏রাম নরায়ণ রাম🔱🌹

বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ, ২০২২

মেয়েরা কোন ধরনের ছেলেকে পছন্দ করে?

মেয়েদের সম্পর্কে কিছু মনস্তাত্ত্বিক কৌশল জানাবেন িক? ১. সুঠাম স্বাস্থ্যবান পুরুষ মেয়েদের বরাবরই বেশ পছন্দের। ২. ক্লিন শেভের চেয়ে দাড়ি গোফওয়ালা ছেলেরা মেয়েদের কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। ৩. মেয়েরা সুন্দর করে উপস্থাপন করতে পারা ছেলেদের বেশি পছন্দ করে। ৪. শিশুদের প্রতি মেয়েদের আলাদা টান কাজ করে, এটা তাদের মমত্ববোধের একটি দিক। ৫. বুদ্ধিমান হিসেবে উপস্থাপন করা ছেলেদের প্রতি মেয়েরা অধিক পরিমাণে আকৃষ্ট হয়। ৬. যেসব ছেলে বিপদ আপদে ঝাপিয়ে পড়ে তাদের দিকে মেয়েরা বেশি আকৃষ্ট হয়। ৭. বাদ্যযন্ত্র বিশেষ করে গিটারে পারদর্শী ছেলেদের প্রতি মেয়েদের আকর্ষণ বেশি। ৮. একটি মেয়ে একটি তার মেয়ে বন্ধুর চেয়ে ছেলে বন্ধুকে অধিকতর বেশি বিশ্বাস করে। ৯. মেয়েরা তার প্রিয় মানুষের কাছ থেকে সবসময় আস্থা রাখতে চায়। ১০. মেয়েরা চায় সে যেন তার জীবনসঙ্গীকে নিয়ে গর্ব করতে পারে।

বালক ব্রহ্মচারী মহারাজ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

*পরম পিতার সংক্ষিপ্ত জীবনী***** জন্মসিদ্ধ ঠাকুর বালক ব্রহ্মচারী মহারাজ এসেছেন ইতিহাসের ধারায়, জন্ম থেকেই প্রকৃতির নিজস্ব সুর নিয়ে। তাই অষ্টসিদ্ধিতে তার জন্মগত অধিকার। আজ থেকে প্রায় পাঁচশাে বছর আগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তার মাতুল বিষ্ণুদাস ঠাকুরের কাছে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তিনি আবার মাতুল বংশের ত্রয়ােদশ উত্তর-পুরষে ভাগিনেয়রূপে এ ধরায় অবতীর্ণ হবেন। মহাপ্রভুর এই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বংশপরম্পরায় বিষ্ণুদাস ঠাকুরের বংশে চলে আসছে। বিষ্ণুদাস ঠাকুরের জামাতা গােপীনাথ কণ্ঠাভরণ এই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা তার “নাগার্জুন” গ্রন্থে লিখে গেছেন। বিষ্ণুদাস ঠাকুরের ত্রয়ােদশ উত্তর পুরুষে বিভিন্ন শাখা-ভাগিনেয়দের মধ্যে একমাত্র শ্রীশ্রী ঠাকুরের মধ্যেই অলৌকিক অষ্টসিদ্ধির প্রকাশ জন্ম থেকেই দেখা যায়। যােগীবর লােকনাথ ব্রহ্মচারী সাধক অশ্বিনী চ্যাটার্জীকে অর্ধমন্ত্র দিয়ে বলেছিলেন যে, প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে এক পূর্ণব্রহ্ম অবতার এসে তার অর্ধমন্ত্র পূর্ণ করে দেবেন। তৈলঙ্গস্বামীও অশ্বিনী চ্যাটার্জীকে একই আশ্বাস দেন যে, প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে এক পূর্ণব্রহ্ম অবতার তার গুরু হবেন। তখন শ্রী শ্রী ঠাকুরের মাতারও জন্ম হয়নি। পরবর্তীকালে প্রায় সেই নির্দিষ্ট সময়েই শ্রীশ্রীঠাকুর, তখন নিতান্তই বালক, নৌকাযােগে মুন্সীগঞ্জ যাচ্ছিলেন। হঠাৎ নদীতে ঝড় ওঠে, বাধ্য হয়ে নিকটের একটি চরে রাত কাটাতে হয়। সেই চরেই ছিল অশ্বিনী চ্যাটার্জীর সাধন কুটীর। কে এক বালক মহাপুরুষ এসেছেন শুনে অশ্বিনী চ্যাটার্জী তখনই নদীর ঘাটে গেলেন। সেই আশ্চর্য পরিবেশেই শ্রীশ্রীঠাকুর বৃদ্ধ অশ্বিনী চ্যাটার্জীর অর্ধমন্ত্র পূর্ণ করে দিলেন। লােকনাথ ব্রহ্মচারীর ভবিষ্যদ্বাণী সফল হল। লােকনাথ ব্রহ্মচারী তার আর এক ভক্তকে মন্ত্র দিলেন না, পরিবর্তে একখানি গেরুয়া কাপড় দিয়ে বললেন, “আজ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে এক পূর্ণব্রহ্ম অবতার তাকে গেরুয়া কাপড়টি পরে আসতে বলবেন এবং তিনি তােকে দীক্ষা দেবেন”। প্রায় নির্দিষ্ট সময়ে, আড়াইহাজার গ্রামে একদিন ভােরবেলা হঠাৎ যেন ভুল করে শ্রীশ্রীঠাকুর যােগেশ চৌধুরীর বাড়ীতে গিয়ে কড়া নাড়লেন। বিস্মিত যােগেশ চৌধুরীকে গেরুয়া কাপড়খানি পরে আসতে বললেন। বহুদিনের কথা, তাই কাপড়টি খুঁজতেই দু’দিন সময় লেগে গেল। গেরুয়া কাপড় পরিহিত বৃদ্ধ যােগেশ চৌধুরীকে যথাসময়ে দীক্ষামন্ত্র দিয়ে শ্রীশ্রী ঠাকুর লােকনাথ ব্রহ্মচারীর এই ভবিষ্যদ্বাণীও সফল করলেন। কঠিন রােগাক্রান্ত প্রৌঢ়া ষােড়শী ঠাকরুণের শেষ অবস্থা – সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে সােড়শী স্বপ্ন দেখছেন যে, তিনি এক স্বর্গীয় দূতের সঙ্গে অপরূপ ফুলে-ফলে শােভিত এক মনােরম পথ দিয়ে চলেছেন। শরীর, মন অদ্ভুত হাল্কা। একটি অপূর্ব সুন্দর বাগানের মধ্য দিয়ে একটি বিশাল কক্ষে ঢুকলেন তারা। মাঝখানে শূন্যে ঝােলানাে ফুলের আসনে বসে আছেন এক জ্যোতির্ময় দেবমূর্তি। ষােড়শীর চোখ ঝলসে যায় – তিনি চোখ বােজেন। পরমুহূর্তেই শুনতে পেলেন সেই দেবতার আহ্বান, “এদিকে তাকাও”। ষােড়শী তাকিয়ে দেখেন শত সহস্র চন্দ্রের স্নিগ্ধ কিরণে আলােকিত এক অপূর্ব দেবমূর্তি। তিনি বলছেন, “না, ফিরে গিয়ে অপেক্ষা কর। আমি যাচ্ছি, তােমায় ডেকে নেব।”… তারপর প্রায় পঁচিশ ত্রিশ বছর কেটে গেছে। গ্রামে বালক ঠাকুর এসেছেন শুনে ষােড়শীও দর্শন করতে গেছেন। নবীন যুবক বালক ঠাকুরের সঙ্গে সেই স্বপ্নে দেখা দেবতার আশ্চর্য মিল দেখে যােড়শী সবিস্ময়ে বলেন, “তােমার আর দুই হাত কোথায় ?” ঠাকুর বলেন, “যখনকার যেমন, সেইভাবে চলতে হয়।” ঠাকুরের জন্মের কিছু পূর্বে হিমালয়বাসী মহাযােগী আদিত্যনাথ বাবা বলেছিলেন যে, এবার এক পূর্ণব্রহ্ম অবতার আসবেন বাংলাদেশেরই মাটিতে। তঁকে চিনবে শুধু কয়েকজন ঋষি, ঋষিকল্প পুরুষ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গেরা। প্রচ্ছন্ন হয়ে তিনি তার কাজ করে যাবেন। পৃথিবীর বুকে এক বিরাট পরিবর্তনের ঢেউ বইয়ে দিয়ে ফিরিয়ে আনবেন মহাশান্তি। পরিশেষে প্রকট হবেন সচ্চিদানন্দঘন ভগবান রূপে। শ্রীশ্রী ঠাকুরের জন্মের পূর্বে, মাতা চারুশীলা দেবী তিনটি স্বপ্ন দেখেন – একবার বিষ্ণুকে, একবার শিবকে, একবার শ্রীকৃষ্ণকে। তারা একই সুরে সেই বিরাট মহানের আগমনের সংবাদ বলে যান। জন্মের কিছু পুর্বেমনসা পূজার দিন এক পাগল সাধক এসে বলে যান, “সে আসছে রে, আসছে! এলে আবার আমি আসবাে।” কালীপূজার দিন পূজা আরম্ভের লগ্নে, মুক্ত আকাশের নীচে পূজামণ্ডপের। আঙ্গিনায় শ্রীশ্রীঠাকুরের আবির্ভাব এক পরম বিস্ময়। সেদিন ছিল ২৩শে কার্তিক, ১৩২৭ সাল। ঢাকা বিক্রমপূরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে বিখ্যাত বৈদিক বাড়ী — সেখানে কালীপূজা উৎসবের আয়ােজন চলেছে। আসন্নপ্রসবা মাতা চারুশীলা দেবীর কোন প্রসব বেদনাই ছিল না। সারাদিন রান্নাঘরে কাজ করেছেন। পূজার লগ্ন বয়ে যায়, নিকটে কেউ নেই, তাই চারুশীলা দেবী নিজেই চিনির থালা নিয়ে পূজামণ্ডপের দিকে এগিয়ে যান। আঙ্গিনাতে নেমে দুই এক পা যেতে না যেতেই হঠাৎ কি যেন হল। চিনির থালা হাত থেকে পড়ে গেল। কিছু বুঝবার আগেই দেখেন মাটিতে শুয়ে হাত পা ছুঁড়ছে এক অপূর্ব দেবশিশু। তার শরীরে ছিল না কোন ক্লেদ চিহ্ন, যেন সেই মুহূর্তে কেউ তাকে স্নান করিয়ে শুইয়ে দিয়ে গেছে; চোখ দুটি তার বুঝে ভরা – সবার গতিবিধি লক্ষ্য করছে। সেই আলাে-আঁধারি আঙ্গিনাতেও তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে – দেহে এক অপূর্ব জ্যোতি। কিন্তু মুখে কোন শব্দ নেই। শিশুর আবির্ভাবে বৈদিক বাড়ীর বিখ্যাত কালীপূজায় পড়লাে বাধা, ছাগশিশুর প্রাণরক্ষা হল। সবাই সমালােচনা করতে লাগলাে যে, একটা বােবা ছেলের জন্য মায়ের পূজা বন্ধ হয়ে গেল। শিশুর জ্যেঠিমা মনােরমা দেবী এই অলৌকিক জন্ম লক্ষ্য করেছিলেন বলেই হেট হয়ে শিশুকে কেঁদে জানিয়ে দিতে বললেন যে সে বােবা নয়। তিনবার চিৎকার করে শিশু সবাইকে বুঝিয়ে দিল যে সে সুরে ভরপুর! শিশুর এক জ্যাঠামশায়, সুন্দর ঠাকুর বিখ্যাত জ্যোতিষী। ছ’দিন পার না হলে জন্মপত্রিকা করতে নেই। কিন্তু এই অলৌকিক জন্ম দেখে তিনি সব সংস্কার উপেক্ষা করে তখনই গণনায় বসে গেলেন। গণনা শেষ হতেই দুচোখ বেয়ে তার আনন্দাশ্রু পড়তে লাগলাে। তিনি বলে উঠলেন, “এ কালাপাহাড় নয়, এ যে কালাচাঁদ – জন্ম সন্ন্যাসী। আমাদের সাতপুরুষ উদ্ধার হয়ে গেল।”ঠিক সেই সময়ে এসেছে রে, এসেছে’ বলতে বলতে সেই পাগল সাধক এসে উপস্থিত হলেন। কৌতূহলী আত্মীয়েরা জিজ্ঞাসা করলাে, “কে এসেছে?’ ‘পরে বুঝবি-পরে বুঝবি’ – বলতে বলতে সাধক চলে যান। | সেদিন ষষ্ঠী – শিশুর বয়স ছ’দিন। সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে। এক একবার যখন বৃষ্টি থেমে আসে, শিশু সােৎসাহে জোরে জোরে হাত নাড়ে, বৃষ্টিও প্রবল। বেগে আসে। যেই হাত নাড়া বন্ধ করে, বৃষ্টিও থেমে আসে। আবার সঙ্গে সঙ্গে জোরে জোরে হাত নাড়ে, প্রবল বেগে বৃষ্টি নামে। সারাদিন তার এই খেলা চলতে থাকে। বৃষ্টির জন্য নিমন্ত্রিতেরা কেউ আর শিশুকে আশীর্বাদ করতে আসতে পারেন না। দুগ্ধপােষ্য শিশু, অথচ কি আশ্চর্য তার বােঝবার ক্ষমতা! মা ছাড়া আর কারাে বুকের দুধ সে স্পর্শ করে না। আত্মীয় এবং প্রতিবেশী মহিলারা শিশুর মায়ের পিছনে মুখ লুকিয়ে নিজেদের বুকের দুধ এগিয়ে দেন; শিশু কিন্তু ঠিকই বােঝে, মুখ ফিরিয়ে নেয়। যৌথ পরিবার। বৈদিক বাড়ী বারাে ভাইয়ের বাড়ী, সুতরাং সমবয়সী শিশু অনেক আছে – একই বিছানায় শুইয়ে রেখে মায়েরা কাজকর্মে যান। যখন অন্য শিশুরা কাঁদে, শিশু ঠাকুর চুপ করে থাকে। যখন তাদের কান্না থামে, শিশুঠাকুর কেঁদে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মা ভাবেন, শিশুর দেহের রং ফর্সা বলে অন্ধকার ঘরেও তাকে স্পষ্ট দেখা যায়। অন্যান্য আত্মীয়াদের কাছে কিন্তু তার নিজস্ব দেহের অস্বাভাবিক জ্যোতি ঠিকই ধরা পড়ে। কাজের চাপে অলৌকিক ঘটনা মা-জ্যেঠিমারা প্রথমে দেখেও দেখেন না, পরে অবসর সময়ে ঘটনাটির কথা মনে করে আশ্চর্য হয়ে যান। তাই সেবার দেড়বছরের শিশুঠাকুরকে খাইয়ে দাইয়ে বিছানায় শুইয়ে রেখে মা জ্যেঠিমারা। যখন রান্নাঘরে যাচ্ছেন, উঠানে নেমেই দেখেন শিশু কাদামাটি মেখে খেলা করছে। তাদের আগে কি করে শিশু এল, সে চিন্তা তাদের তখন আসেনি, ছেলেকে আবার পরিষ্কার করে শুইয়ে দিতে হবে — সে চিন্তায়ই তারা বিভাের। বার বার যখন একই ঘটনা ঘটতে লাগলাে, আশ্চর্য হওয়ার পরিবর্তে তাদের সময় নষ্ট হচ্ছে বলে বিরক্ত হয়ে উঠলেন। শেষে অবসর সময়ে চিন্তা করে অবাক লাগলাে তাদের। ছয়মাস বয়সেই শিশুঠাকুর মায়ের সঙ্গে গেলেন পিতার কর্মস্থল ত্রিপুরা। জেলার উজানচর-কৃষ্ণনগর গ্রামে। এখানেই ঠাকুর শশীকলার মত বাড়তে লাগলেন নানা অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। সময় বিশেষে নিজের শক্তি লুকিয়ে রাখেন, আবার যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভূতির প্রকাশ হয়ে পড়ে, তিনি হালকা করে দিতে চেষ্টা করেন। ৬ মায়ের সাথে মামাবাড়ী দোগাছি বা ঢাকায় মামার বাড়ীতে যান, আবার পৈতৃক বাড়ী মেদিনীমণ্ডলেও যান। সেবার ঢাকাতে জন্মাষ্টমী মিছিল দেখছেন মায়ের সঙ্গে। বয়স মাত্র দু’বছর। হঠাৎ মিছিলের লােকেরা হৈ চৈ করে উঠলাে। চমক ভাঙতে মা দেখেন, শিশু দোতলার রেলিং এর ফাক দিয়ে নীচে পড়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে মিছিলের এক বৃদ্ধ হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল। কিন্তু কত সময় লাগছে—হালকা পালকের মত পড়ছেন শিশু। বৃদ্ধের হাতের উপর পড়ে খিল খিল করে হেসে উঠল। বৃদ্ধ দেখলাে, শিশুর দেহের যেন কোনাে ওজন নেই। দ্বিগুন উৎসাহে মিছিল চললাে এগিয়ে নাম-সংকীর্তন করতে করতে। তিন-চার বছর বয়সে শিশুকে প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যায় না। কখনও কলা বাগানে, কখনও সুপারী বাগানে শিশু বসে থাকেন ধ্যানমগ্ন। প্রথম প্রথম খেলার সাথীরাও এও একটা খেলা ভেবে বসে। তারপর বনের শিয়ালগুলাে এসে যখন ঠাকুরকে ঘিরে বসে, তারা ভয়ে উঠে যায়। আত্মীয়স্বজন, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী তাঁর অলৌকিক বিভূতির কথা শুনেও বিশেষ খেয়াল করে না, কিন্তু গ্রামের সরল নিরীহ মানুষ তাঁকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করে চরণামৃত নেয়, নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। ( দেশের বাড়ীতে জ্যাঠতুতাে ভাই-বােনদের সাথে শিশুঠাকুরও পূজার ফুল তুলতে যান। সবাই যখন ফুল তুলতে ব্যস্ত, তিনি ফুলের সাজি থেকে ফুলগুলাে নিয়ে নিজের পায়ে ঢালেন। ভাই-বােনেরা ভগবান শাপ দেবে’বলে ভয় দেখালে বলেন, “ও, তােদের ঠাকুর বুঝি খুব রাগী? আমি যদি ঠাকুর হতাম, তবে কখনও রাগ করতাম না, বরং সবাইকে ভালবাসতাম। খুব ভালবাসতাম”। আবার বলতেন, “পাথরের ঠাকুরকে ফুল দিয়ে কি লাভ?” দিদিরা বকলে বলতেন, “মাটি পাথর যদি ভগবান হয়, তবে মায়ের মশলা পেষা নােড়াটাও ভগবান।” পাঁচ বছর বয়স থেকেই অফুরন্ত তত্ত্বের স্ফুরণ দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। অ, আ, ক, খ শিখছেন সবে কিন্তু আনন্দ মাষ্টারকে বলছেন, “সবাই আমরা চৈতন্যময় মহাশূন্যেই বিরাজ করছি। মহাশূন্যের সীমা নেই, বস্তুরও তাই সীমানা খুঁজে পাওয়া যায় না … সেই মহাবিরাটের সাড়ার সাড়া আমাদের সবার মধ্যেই আছে। … আমি, আপনি, আমরা সবাই তাে সেই একই সাড়াতে ডুবে আছি। বাস্তব বােধ নিয়ে, বাস্তবের সত্তা নিয়ে এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর চিন্তা করে যান। বাস্তবের এই ধারা দিয়েই চলে যান, ডুবে যান সেই ধারাতে, যে ধারাতে এসেছেন”। যেমন ভাষার মাধুর্য, তেমনি ভাবসম্পদ। আনন্দ মাষ্টার ভাবেন – এই শিশু কোথায় পান এই তত্ত্বের সন্ধান! [ অষ্টসিদ্ধি নিয়েই তার আবির্ভাব, সুতরাং প্রায় প্রতি ঘটনার মধ্যে দিয়েই তাঁর অলৌকিক সত্তা প্রকাশ পায়, আর তার মধ্যেই দেখা যায় অণিমা, লঘিমা, কাম্য, ব্যাপ্তি প্রভৃতি অষ্টসিদ্ধির প্রকাশ। বাস্তবের লেখাপড়া, খেলাধূলা সবটার মধ্যেই তিনি আছেন, আর তার মধ্যে দিয়েই সবাইকে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। পাঁচ বছর বয়সেই প্রথমে লববাবুর পাঠশালায় ভর্তি হন, পরে আনন্দ মাষ্টারের পাঠশালায় এবং তারপর উজানচর কংসনারায়ণ হাইস্কুলে পড়েন। খুব মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তার লেখাপড়া করার সময় বেশী হত না শিষ্য ভক্তদের প্রয়ােজন মেটাতে মেটাতেই বেশীর ভাগ সময় কেটে যায়। আবার তার মধ্যে স্বতঃস্ফুর্ত বিভূতির খেলা চলে। তাই আনন্দ মাষ্টারের সান্ত্বনার বাণীতে সন্তুষ্ট হয়ে শিশুঠাকুর তিতাস নদীর জলের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে ভেসে যাওয়া ঘটিটা নিয়ে আসেন; হতবাক হাজি সাহেবের চোখের সামনে জলের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে জেলেদের নৌকা থেকে জীবন্ত মাছগুলাে ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেন, অবশ্য মাছের দাম দিয়ে দিতে ভােলেন না;পিতার সহকর্মী বরােদাবাবুর সামনে তিতাসের জলের উপর দিয়ে হেঁটে আসেন; আয়েত আলি, আপ্তাবুদ্দিন প্রভৃতি হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমানের প্রত্যক্ষ দৃষ্টির সামনে পাঁচ বছরের শিশু ধ্যানাসনে বসে তিতাসের উপর দিয়ে ভেসে যান। তাই তাে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান তাঁর পাদপদ্মে আশ্রয় নেয়। . ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই তিনি দীক্ষা দিতে শুরু করেন। মহাপ্রভুর মাতুল বংশের বিভিন্ন ধারার ত্রয়ােদশ উত্তরপুরষে বহু ভাগিনেয় এসেছেন। কার ঘরে মহাপ্রভু আসবেন তা তাে জানা নেই, সুতরাং সকলেরই একটা আশা ছিল। শ্রী শ্রী ঠাকুরের জন্মের সাথে সাথে অলৌকিক বিভূতির সমাবেশ সেই বিরাট প্রশ্নের সমাধান করে দিল যে, তিনিই মহাপ্রভুর মূর্তবিগ্রহ। যিনি দুই-আড়াই বছর বয়স থেকে গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকেন, সবাই বুঝলাে যে তিনি তাে সাধারণ হতে পারেন না। চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই বহু ভক্ত আসে, তাদের নানা সমস্যার সমাধান খোঁজে। একটি-দুটি কথায় শিশু ঠাকুর তাদের গুরুতর সমস্যা পর্যন্ত সমাধান করে দেন। পাঁচ বছর বয়সেই অফুরন্ত তত্ত্বের ফোয়ারা বের হতে থাকে – মানুষ মুগ্ধ হয়ে শােনে। ছয়-সাত বছর বয়স থেকে তাে দীক্ষা দিতেই শুরু করলেন, যখন তার খেলার সাথীদের মধ্যে অনেকেই উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাদের বােধশক্তিই ভাল করে হয় নি, তিনি তখন সবে পাঠশালায় পড়া শুরু করছেন। এই বয়সে পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, পাঠশালার মাষ্টার, যাঁদের ঠাকুর প্রণাম করেন, যাঁরা কোলে পিঠে তাকে মানুষ করেছেন, যাঁদের ফুট-ফরমাস তিনি খেটেছেন – তারাই এসে দীক্ষা নিতে শুরু করেন। সঠিকতা না থাকলে পাড়া প্রতিবেশী কখনও সহজে মাথা নােওয়ায় না। এই শিশু বয়সেই যখন আশ্চর্য অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়েছেন, তার পূর্বে নিশ্চয়ই একটা প্রস্তুতি-পর্ব ছিল। সুতরাং যারা জন্মান্তরে বিশ্বাস করে না, তারাও স্বীকার করতে বাধ্য হল যে নিশ্চয়ই তিনি পূর্বজন্মে। চরম সিদ্ধি লাভ করেছেন, তা না হলে এত শিশু বয়সে তার অণিমা-লঘিমাদি এত উচুদরের বিভূতির প্রকাশ, এত নিগূঢ় তত্ত্বের স্ফুরণ হতে পারে না। তাই তারা শিশু-ঠাকুরকে ‘জন্মসিদ্ধ’বলতে শুরু করলাে – জন্ম থেকেই অষ্টসিদ্ধি নিয়ে এসেছেন। যে যা জিজ্ঞাসা করতাে, সহজভাবে সব তিনি বলে দিতেন। যেমন, একজন তার পিতার আয়ু সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করায় ঠাকুর বলে দিলেন যে, তার আর তিন বছর আয়ু আছে। সে তখনই পিতার নামে বহু টাকার ইনসিওরেন্স করে ফেলে। শিশু ঠাকুরের কথা যখন ফলে গেলাে, অনেকেই। এসে ঠাকুরকে অনুরােধ করলাে যে তিনি যেন এভাবে বলে না দেন, তাতে অনেককে অনেক অসুবিধায় পড়তে হয়। সেই থেকে ঠাকুর সহজভাবে সবাইকে সবকিছু বলে দেওয়া অনেকটা কমিয়ে দেন। সেই সময়েই খেলার সাথী, সহপাঠী, বর্ষীয়ান পাড়াপ্রতিবেশী, ভক্ত-শিষ্যদের জপধ্যান করতে বসান, নিজেও বসেন এবং তার মাঝেই কখনও অদৃশ্য হয়ে, কখনও বা আসনে বসে থেকেই দূর দেশ থেকে ঘুরে আসেন। এমন প্রমাণ রেখে আসেন যে, তিনি যে সেখানে গিয়েছিলেন তা সহজেই বােঝা যায়। ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করাটা তার কাছে সব সময়ই সময়ের অপব্যবহার। সাথীদের নিয়ে রাত্রে ধ্যানে বসেন এবং কয়েক মহূর্তের মধ্যে আসন থেকে অদৃশ্য হয়ে যান — সাথীরা নদীর ঘাটে, কলাবাগিচা প্রভৃতি সম্ভাব্য জায়গায় খোঁজে, তার দেখা পেলেও ধরতে পারে না, আবার তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। আবার কখনও নদীর ওপার থেকে তার গলা শুনতে পায়। এই ভাবে সারারাত ছােটাছুটি করে যখন সাথীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন তিনি ধরা দেন। আবার মাঝে মাঝে কথাবার্তা হাসিঠাট্টার মধ্যে তিনি নিজেকে বহুতে পরিণত করেন। যতটি ভক্ত – ততটি ঠাকুর, প্রত্যেকের সামনে একটি ঠাকুর বসে আছেন। ভক্তেরা যখন এই সব বিভূতি দেখে জিজ্ঞাসা করে, ঠাকুর বলেন, “একটা লাফ দিয়ে যদি শূন্যে এক সেকেণ্ডের জন্য থাকা যায়, তবে দশ মিনিট, কুড়ি মিনিট, দু’ঘণ্টা বা তারও বেশী থাকা যাবে না কেন? বলবে যে, সে কি থাকা যায় ? থাকা অসম্ভব, কি করে হবে? এই সব হবে না’, ‘পারবাে না’, ‘অসম্ভব’ বলতে বলতে মনের সহজ গতির পথটা আটকে ফেলেছে। যদি বলি– নদীর উপর দিয়ে হেঁটে যাও, বলবে, কী করে যাবাে? ডুবে যাবাে তাে’! এই যে সন্দেহ, দ্বন্দ্ব, দ্বিধা — এতেও তােমাদের সহজ গতির পথটা আটকে দিয়েছে। না পারার’সাধনাতেই সিদ্ধি লাভ করেছ। একটা পিনের খোঁচা দিয়ে পথটা একটু পরিষ্কার করে দেও —মনের ‘কিন্তু’টা দূর করাে — দেখবে সবটাই তােমার আয়ত্তের মধ্যে আছে। আমার মনের স্বচ্ছ গতিটা ঠিক আছে, তাই আমার কাছে এগুলাে কোনাে সমস্যা নয়।এ সব তােমরাও পারবে, চর্চা করে যাও তবেই হবে। নিজের মধ্যে যে শক্তি আছে, তাকেই বাড়িয়ে তুলতে হবে।” উৎসাহিত হয়ে তারাও বেশী করে জপধ্যান করে – কিছু দর্শনও পায়।। সাত আট বছর বয়স। মামার সঙ্গে বাজারে যাচ্ছেন হরিজন পট্টির ভিতর দিয়ে। শুয়াের দেখে ঠাকুর বলে উঠলেন, “মামা, মামা, দেখেন ছুঁচোগুলাে কত বড় হয়েছে!” মামা শিশুর নির্বুদ্ধিতা দেখে হাসলেন, বললেন, “ওগুলাে ছুঁচো নয় রে, ওগুলাে শুয়াের।” সরলভাবে শিশু জিজ্ঞেস করেন, “শুয়াের বলে যে গালাগাল দেয়, সেই শুয়াের ?” মামা বললেন, “হ্যা”। আবার এই বয়সেই যখন ঠাকুর ভােলাগিরি আশ্রমের পুষ্করিণীতে স্নান করে উঠে আসছেন – পরনে একটি গামছা, গায়ে আরেকটি, হাতে করঙ্গ, পায়ে খড়ম,— ভক্ত-পরিবৃত ভােলাগিরির তার দিকে দৃষ্টি পড়ল। তাড়াতাড়ি পুষ্করিণীর ধারে এসে ঠাকুরকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “মেরা জনম সার্থক হুঁই, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ মিল গেয়ি।” ঠাকুর করুণার দৃষ্টিতে বৃদ্ধ ভােলাগিরির দিকে তাকালেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। এইভাবে একজনের কাছে তিনি ধবা দেন, আর একজনের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। | ১৭৮ বছর বয়স্ক বিখ্যাত সাধক মনাই ফকির ছিলেন লােকনাথ ব্রহ্মচারীর অন্তরঙ্গ বন্ধু। মনাই ফকির স্বপ্নাদেশ পেয়ে এলেন ঠাকুরের কাছে এবং দীক্ষা গ্রহণ করে জীবন সার্থক করলেন। ঠাকুরের তখন আট-নয় বছর বয়স। গভীর রাত্রে এসে ঠাকুরের সামনে বসে ধ্যান করেন আবার দোতারা বাজিয়ে ঠাকুরকে আল্লাতাল্লার গান শােনান। এই ভাবে কেউ আসেন প্রত্যাদেশ পেয়ে, কেউ আসেন অন্তরের টানে নিজ নিজ উপলব্ধির স্তর থেকে | উপনয়ন হওয়ার পর যেদিন নিয়মভঙ্গ করে ঘর থেকে বের হলেন, সেদিন হঠাৎ চারজন বৃদ্ধ নাগাসন্ন্যাসী এসে উপস্থিত। নবীন বালক ঠাকুরকে ওঁরা প্রণাম করলেন, ঠাকুর হাত তুলে আশীর্বাদ জানালেন, মুখে কিছু বললেন না। বিদায় নেওয়ার সময় তারা ঠাকুরের দিদিমাকে বলে গেলেন “মা, আপনি ভাগ্যবতী। আমরা চালডালের ভিক্ষুকনই। বহু জায়গায় আমরা জ্ঞানের সন্ধানে ঘুরেছি, সব জায়গায়ই তল পেয়েছি। এখানেই বলে গেলাম, আমরা তল পাচ্ছি। , ওঁর গভীরতার থৈ পাচ্ছি না – ডুবে যাচ্ছি।” কোন্ উপলব্ধির স্তর থেকে এই সন্ন্যাসীরা বালকের সন্ধান পেয়েছিলেন, কোন্ উপলব্ধির স্তর থেকে তার জ্ঞানের গভীরতার হদিশ পেলেন, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বলা শক্ত। শুধু মানুষের প্রতি নয়, সমস্ত জীবজাতির প্রতি তার অপার করুণা। তাই স্কুলের টিফিনের সময় নদী থেকে বালতি বালতি জল টেনে এনে উজানচর কাছারীর মাঠে বাঁধা গরুগুলােকে রােজ খাওয়ান। প্রতিদিন যে তাকে প্রায় দু’শাে বালতি জল টানতে হয়, তাতে তার কোন ক্লান্তি ছিল না। দিয়েই তাঁর তৃপ্তি, প্রতিদানে কিছু চান না। বাজারে জীয়ন্ত মাছ কাছিম দেখলে কিনে নিয়ে এসে জলে ছেড়ে দেন। তারা মনের আনন্দে নদীর জলে ডুব দেয়। ছােটবেলা থেকেই ঠাকুর নিপীড়িত মানুষের দুর্দশার কথা চিন্তা করেন। ধনীগােষ্ঠীর শােষণে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন এবং কি ভাবে সবাইকে এক করে এক শােষণমুক্ত, বিবেকাধীন, সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলা যায়, সেই চিন্তা তার সব সবয়েই আছে। বিদেশীদের প্রতি তার কোন বিদ্বেষ নেই, কিন্তু তাদের শােষকের ভূমিকা তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। দেশের তখনকার দুর্বল নীতিকে তিনি সমর্থন করেন না, তিনি চান বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। প্রতিটি মানুষের- প্রতি তার অসীম ভালবাসা। কাউকে তিনি ফেলে দেননা, সবাইকে অন্তর দিয়ে কোলে টেনে নেন। তাঁর প্রতিটি কথায়, প্রতিটি আচরণে ফুটে ওঠে এক অপুর্ব দেশপ্রেম ও দেশাত্মবােধের ছবি। দোগাছি বণিক্যদের বাড়ী মনসা পূজা উপলক্ষ্যে ‘রয়ানি’ গান চলছে। মাঝে কিছুক্ষণের বিরতি। পরম করুণাময় ঠাকুর একটা মরা প্রজাপতির ছড়িয়ে থাকা শরীরের অংশগুলাে কুড়িয়ে নিয়ে জোড়া দিতে লাগলেন। তারপর কোষা থেকে একটু জল ছিটিয়ে দিয়ে বললেন যা’ – প্রজাপতিটা উড়ে চলে গেল। প্রজাপতিটার অকাল মৃত্যুতে হয়তাে ব্যথা পেয়ে তাকে ঠাকুর জীবন দান করলেন। কিন্তু যারা ঠাকুরের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিল, তাদের কাছে এটা অকল্পনীয়, তাই তারা পাগলের মত ছুটে এসে তার পায়ে পড়লাে। যিনি মরাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারেন, তিনি ভগবান ছাড়া আর কে। | আড়াইহাজারের নাস্তিক জমিদারবংশ যে ঠাকুরের চরণাশ্রিত হয়েছিল, তার পিছনেও প্রায় একই রকমের ইতিহাস। বিজ্ঞানশিক্ষক সুধীর বসু ডাক্তারী মতে মৃত। ডাক্তারেরা ডেথ সার্টিফিকেট’লিখতে যাচ্ছেন, এমন সময় কয়েকজন ঠাকুরকে নিয়ে উপস্থিত হল। ঠাকুর সুধীর বসুর দ্বিদলে অঙ্গুলি স্পর্শ করা মাত্রই সে চোখ মেলে তাকালাে – তার নাড়ীর গতি স্বাভাবিক ভাবে চলতে শুরু করলাে। মৃতের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতে পারেন যিনি, তার পাদপদ্মে। আশ্রয় নেওয়া তাে ভাগ্যের কথা। তাই কট্টর নাস্তিক জমিদারেরা নির্দ্বিধায় আত্মসমর্পণ করলেন। | আনন্দময়ী মা যে ঠাকুরকে “নারায়ণ-নারায়ণ” বলে জড়িয়ে ধরেছিলেন, তার পিছনেও ছিল প্রায় একই শক্তির খেলা। আনন্দময়ী মার প্রিয় শিষ্য জ্যোতিষ রায়ের পুত্র রামানন্দ রায়ের শেষ অবস্থা – ডাক্তারেরা জবাব দিয়েছেন। মা মণিকুন্তলা রায়ের পীড়াপীড়িতে, ঢাকার কামিনী জজের স্ত্রীর অনুরােধে ঠাকুর গেলেন রােগীকে দেখতে। ঠাকুরের স্পর্শে রামানন্দ রায় সাতদিনের মধ্যে ভাল হয়ে উঠলাে। দল সর্বসংস্কারমুক্ত শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে কোন ভেদাভেদ নেই, জাতিধর্মের বিচার নেই। ধনী-গরীব, জ্ঞানী-মূখ সবাই তার কাছে সমান। সবাইকে তার অনন্ত প্রেম- ভালবাসা দিয়ে কাছে টেনে আনছেন। এখানকার সংস্কার হাতে নিয়ে নির্ভীকভাবে সম্প্রদায়গত ধর্ম, কল্পনার স্বর্গ-নরক, পাপ-পুণ্যের বেড়াজাল অপসারণ করে মানুষকে নিয়ে যাচ্ছেন সেই মুক্ত অসীম মহাকাশের পথে। উদাত্ত কণ্ঠে ডাকছেন, “হে পথিক, হে যাত্রিক, হাতে নাও দেহবীণাযন্ত্র, ভিতরে প্রকৃতির সুর। এগিয়ে যাও সমাধানের পথে। এ পথে ভগবান-অবতারের বালাই নেই, নিন্দা-স্তুতির ঝামেলা নেই। আপন মনে, আপন পথে এগিয়ে চল।” কে দিতে পারে এত বড় আশ্বস? পরম করুণার সাগর শ্রীশ্রীঠাকুর মা-বাবাকে কষ্ট দিয়ে, স্ত্রী-পুত্র-পরিবারকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যাওয়া কখনই সমর্থন করেন না। কত ছেলেকে সন্ন্যাস ধর্ম ছাড়িয়ে ঘরে ফিরিয়ে এনে দিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। কারণ ঠাকুরের কথায় বলতে গেলে, “জীবমাত্রেই জন্ম-সন্ন্যাসী। তাই আলাদা করে সন্ন্যাস নেওয়ার প্রয়ােজন নেই। আমাদের জীবন চলার পথ হচ্ছে ভােগের ভিতর দিয়ে, কিন্তু গন্তব্যস্থান হচ্ছে শ্মশান। তাই ত্যাগ করবার কিছু নেই।” ধর্ম সম্বন্ধে ঠাকুরের যুক্তিপূর্ণ বলিষ্ঠ মতবাদ অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়গুলিকে ভাবিয়ে তােলে। যে আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম সমাজকে, মানুষকে রক্ষা করতে পারে না, যে ধর্ম কল্পিত স্বৰ্গনরক, পাপপুণ্যের ভয়ভীতি দেখিয়ে শান্তি স্বস্ত্যয়ন যাগযজ্ঞের বিধান দিয়ে মানুষকে শােষণ করতে, তাকে দুর্বল করতে সাহায্য করে, সে ধর্ম ধর্ম-ই নয়, চরম অধর্ম। সমাজের উপর ঠাকুরের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও প্রতিপত্তি দেখে কতকগুলি সম্প্রদায় ভীত হয়ে পড়ে। ঘরে সাত হাত লম্বা জাতি সাপ ছেড়ে দিয়ে, কখনও নৌকা ফুটো করে পদ্মার জলে ভাসিয়ে দিয়ে তারা ঠাকুরের প্রাণনাশের চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই তাঁর দুর্বার গতি রােধ করতে পারে না। পরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানা অপবাদ দিতে শুরু করে, কিন্তু অপবাদই হয়ে দাঁড়ায় প্রচারের মাধ্যম। যতই অপবাদ ছড়ায়, ততই সহস্র সহস্র মানুষ কাছে আসে। ” সব চেয়ে আশ্চর্যের কথা যে, এই সব দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে তার কোন ব্যক্তিগত অভিযােগ নেই। যে যতই অপরাধ করুক না কেন, তিনি অকুণ্ঠিতভাবে তাদের ক্ষমা করে দেন। পাহাড়ের মানুষ ঠাকুরকে খুব ভালবাসে। পিতা যখন তহশীলে যান, মা যান বাপের বাড়ী, ঠাকুর কোন এক সাথীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পাহাড়ের দিকে। কিন্তু কোন বছরই একমাসের বেশী পাহাড়ে কাটান না। তিব্বতের কাছে লং পাহাড়ে শিবের পােতা ত্রিশূল, যা আর পাঁচজন একত্রে চেষ্টা করেও তুলতে | পারে নি; সেই ত্রিশূল যখন ঠাকুর শিশুবয়সেই অনায়াসে তুলে ফেললেন, পাহাড়ের মানুষ ঠাকুরের শরণাগত হল। কারণ কিংবদন্তী অনুসারে শিবের ত্রিশূল যিনি তুলবেন, তিনি শক্তিতে শিবের সমতুল্য এবং তিনি পৃথিবী শাসন করবেন। দুই-একজন শক্তিধর সাধক ঈর্ষাবশতঃ ঠাকুরের প্রাণহানি করার চেষ্টা করে, কিন্তু ঠাকুরের ক্ষমতার কাছে তাদের ক্ষুদ্র শক্তি অপচয় করে শক্তিহীন হয়ে পড়ে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়। তিব্বত অঞ্চলে যাবার পথে দার্জিলিংয়ে এক লামার বাড়ীতে প্রথম উঠেন। এই লামা পরিবার ঠাকুরকে খুব ভালবাসে এবং শ্রদ্ধা করে। ওখানে থেকে এক লামা সন্ন্যাসীর সাথে তিব্বত অভিমুখে যান — প্রায় পাঁচ-ছয়বার পাহাড় অঞ্চলে যান এবং বহু ঘটনা ঘটে। কোনবারই তিনি পনেরাে দিন থেকে এক মাসের বেশী থাকেন না। = উজানচর কংসনারায়ণ হাইস্কুলে পড়েছেন ঠিকই, কিন্তু কয়েক বছর যাবার | পর দেখা গেল যে তার পক্ষে পড়াশুনা করা চলবেনা। তার কারণ ঠাকুরের ভক্ত-শিষ্যের সংখ্যা এত দ্রুত গতিতে বাড়তে লাগল যে, বাড়ী থেকে স্কুল পাঁচ মিনিটের পথ — সেটুকু অতিক্রম করতেই তার চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট লেগে যায়। ভক্ত শিষ্যদের ভক্তি-অর্ঘ গ্রহণ করতেই সময় কেটে যায়। স্কুলে গিয়েও রেহাই নেই। সেখানেও ভক্ত-শিষ্যেরা গিয়ে হাজির হয়, দেখে কিভাবে তাদের গুরুদেব পড়াশুনা করেন। এদিকে পিতার অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়, অর্থের অনটন। তাই শেষ পর্যন্ত পড়ার পাট চুকিয়ে দিয়ে তার বাল্যলীলাক্ষেত্র এবং পিতার কর্মস্থল ছেড়ে ঢাকা শহরে চলে এলেন। কিছুদিন মামার বড়ীতে থাকার পর ঢাকায় নিজস্ব একটি বাড়ী কিনলেন। প্রচলিত ধর্মের দোহাই দিয়ে তথাকথিত গুরু মহানদের শিষ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে রােজগার করার পদ্ধতি ঠাকুর মােটেই পছন্দ করেন না। তাই বহু শিষ্য-সন্তান থাকা সত্ত্বেও তাকে অনটনের মধ্যেই দিন। কাটাতে হয়, কারণ কারাে কাছ থেকে তিনি দান বা দক্ষিণা গ্রহণ করেন না। ঢাকায় এসে অর্থের প্রয়ােজন বাড়তে লাগল। সতুরাং কয়েকটি ছােটখাট ব্যবসা শুরু করলেন যাতে তার স্বাবলম্বী জীবনে অভাব স্পর্শ করতে না পারে। পূর্বেও যখন ঢাকায় আসতেন, ছােটখাট ব্যবসার মাধ্যমে অর্থোপার্জন করে পিতাকে সাহায্য করতেন। ঠাকুরের প্রতিটি কাজের মধ্যেই আছে মৌলিক অভিনবত্ব। নীরবে লােকচক্ষুর অন্তরালে তিনি হাজার হাজার ছেলেমেয়ে মানুষ করছেন। যাদের অবস্থা একটু ভাল, এই রকম দু’হাজার বাড়ী ঠিক করলেন। তাদের বললেন, “তােমরা আমার একটি ছেলে বা মেয়ে মানুষ করবে। আমি তাে দক্ষিণা নিই না, এটাই হবে গুরু- দক্ষিণা।” পাঁচজনের সংসারে একজন অতিরিক্ত হলে বিশেষ আসে যায় না। তাছাড়া গুরুদেবের জন্য কিছু করতে পারছে, এই যথেষ্ট। তারা সানন্দে রাজী হয়ে যায়। এবার ঠাকুর বললেন, “তােমাদের বাড়ীর আনাচে যে সব পতিত জমি পড়ে আছে, তার থেকে কিছু জমি আমার জন্য রাখবে আর অবসর সময়ে সেই জমি চাষ করে ফসল ফলাবে।” হাসিমুখে সবাই সবজি বাগান গড়ে তােলে, অবসর সময়ের নিরর্থক অলসতা থেকে মুক্তি পায়। কাজের মাধ্যমে সবারই হতে থাকে গুরু স্মরণ। ফসলের সবটা ঠাকুর নেন না, বলেন, “তােমাদেরও তাে পরিশ্রম করতে হয়েছে, সুতরাং ফসলের অর্ধেকটা তােমরা রাখবে।” বাকী অর্ধেক একত্র করে বাজারে বিক্রী করা হয়, আর সেই অর্থে। ঐসব ছেলেমেয়েদের বইপত্র, শ্লেট, কাগজ-পেন্সিল, কাপড়-চোপড় যতটা সংকুলান করা যায়, কেনা হয়। মাঝে মাঝে ঠাকুর গােপনে নিজে গিয়ে বা লােকের মাধ্যমে জমির কাজ করে দিয়ে আসেন – তাতে ভক্তেরা আরও উৎসাহ পায়। ঠাকুর দুই এক টাকা যা প্রণামী পান, তাও খরচ করেন এদের প্রয়ােজন মেটাতে। এইভাবে হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে গড়ে ওঠে, জীবনে। প্রতিষ্ঠিত করে বাপ-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু যে যেখানে থাকুক না। কেন, ঠাকুর ছাড়া আর কাউকে তারা জানে না, তার মধ্যে খুঁজে পায় পিতামাতার চেয়েও স্নেহপরায়ণ আপন জন। ছুটি যখনই পায়, এদের বিভিন্ন দল এসে দু’চার দিনের জন্য ঠাকুর বাড়ীতে থাকে। নতুন লােকে দেখলে ভাবে, ঠাকুর বাড়ীতে এত মেয়ে কেন ? সম্বন্ধটা কি, তারা তাে জানে না। ঠাকুরের যখন চৌদ্দ-পনের বছর বয়স, তখন থেকে শুরু করেছেন এই পরিকল্পনা এবং আজও সেইভাবে চলেছে বিনা আড়ম্বরে, বিনা জাকজমকে। ঢাকা শহরে ঠাকুর অপরিচিত নন – বহু শিষ্য-ভক্তও আছে। বিভিন্ন পত্রিকাতে যখন ঠাকুরের ঐশী শক্তি সম্বন্ধে অনেক ঘটনা প্রকাশিত হল, বুদ্ধিজীবী। মহল আরও বেশী আগ্রহী হয়ে উঠে। বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী যখন দীক্ষা নিলেন, ঢাকা শহরে একটা রীতিমত আলােড়ন হল। অনেক পত্রিকাতেই ঠাকরের কাহিনী বের হতে শুরু করে। রেডিও তখন ঢাকা শহরে প্রায় নতুন — সেই রেডিও-ও যে ইলেকট্রিসিটি ছাড়া বাজতে পারে, তা দেখে। সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল। বলধার জমিদার বাড়ীতে ঠাকুর রেডিওর তারটা ইলেকট্রিক সুইচের সঙ্গে না লাগিয়ে হাতে ধরে রাখতে বললেন এবং আর এক হাতে তার বুড়াে আঙ্গুল ধরতে বললেন। আশ্চর্য হয়ে সবাই দেখলাে কারেন্ট ছাড়াই রেডিও চলছে। ঠাকুর বললেন যে, এই কারেন্ট সবার ভিতরেই আছে। সুতরাং আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, শুধু চর্চা করে বাড়িয়ে নিলেই হল। = “পঞ্চায়েত” পত্রিকায় বের হল—“সম্প্রতি ঢাকায় একজন তরুণ বয়স্ক সুঠাম, সুন্দর মহামানবের শুভাগমন হইয়াছে। তাহার নাম শ্রীমৎ বীরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী। যােগশাস্ত্রোক্ত অণিমাদি অষ্টৈশ্বর্য এবং কায়াব্যুহ, আকাশ বিচরণ, দূরদর্শন, পরলােক- গত ব্যক্তিদের অবতারণ প্রভৃতি যােগবিভূতি তার আজন্মসিদ্ধ । তাহার জ্ঞানের গভীরতা, মনের উদারতা এবং অন্তরের মাধুর্যও অপরিসীম। বহু বিশুষ্ক নদীতে তিনি অমৃতের ধারা প্রবাহিত করিয়াছেন। বহু নরনারীর ব্যথা-বেদনা তার সংস্পর্শে গােলাপ হইয়া উঠিয়াছে। নিতান্ত নাস্তিকগণও তাহার অদ্ভুত যােগৈশ্বর্যের পরিচয় পাইয়া তাহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিতেছেন। গত বুধবার বলধার সুপ্রসিদ্ধ জমিদার শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী তাহার নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছেন। বর্তমানে দেশের যুবসমাজের মধ্যে যেরূপ নাস্তিকতা, উচ্ছলতা ও ঈশ্বরবিমুখতার জোয়ার বহিতেছে, তাহাতে আশা করা যায় যে এই মহামানবের প্রভাবে তাহাদের মধ্যে ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাস পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হইবে।” | মহানন্দ রায়কে যখন হালসীবাগান কালীপূজা মণ্ডপের বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা করলেন, অনেকেই প্রশ্ন করলাে, “ঠাকুর, ঢাকাতে বসে তুমি কি করে কলকাতায় ওকে বাঁচালে?”ঠাকুর বললেন যে, যখন পুজামণ্ডপের একমাত্র পথ দিয়ে মানুষ বেরােতে পারছিল না এবং মৃত্যুবরণ করছিল, মহানন্দ একমনে ঠাকুরকে স্মরণ করছিল। সেই খবর তার রিসিভারে পৌছামাত্র যে কোনাে উপায়েই হােক মহানন্দকে তুলে তিনি বেড়ার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। একে তাে আসন্ন মৃত্যুভয়, তারপর ঐভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া – ওর মনে একটা প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাই ঠাকুর ভক্তদের তখনই একটা টেলিগ্রাম করে দিতে বললেন, “আশীর্বাদ – ঠাকুর।” মহানন্দ ঢাকা পৌছাবার আগেই সবাই তার খবর জানে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। # ঠাকুরের বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিপূর্ণ মতবাদ সবাইকে অভিভূত করে। তারা কতকটা নিশ্চিত হয় যে তাদেরও আধ্যাত্মিক উন্নতির বিরাট সম্ভাবনা আছে। চিরাচরিত যে কথা, কাম কাঞ্চন ত্যাগ না করলে ভগবদ্দর্শন হয় না – এইকথা অনেকের মনেই হতাশার সৃষ্টি করে। কিন্তু ঠাকুর বলেন, “কাম ত্যাগ হয়। কাম ত্যাগ করা যায় না – কেউই এ জগতে কাম ত্যাগ করতে পারে নি; আর কাম ত্যাগ করতে না পারলে যদি ভগবদদর্শন না হয়, তবে কারােরই ভগবদ্দর্শন হয়নি। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক প্রত্যেকটিই লিঙ্গবৎ- চোখে দেখে তৃপ্তি, কানে শুনে তৃপ্তি, গন্ধ শুকে তৃপ্তি, স্বাদে-সােয়াদে তৃপ্তি—এগুলােকে তাে কেউ ত্যাগ করছে না; আর লিঙ্গের বেলায়ই যত ত্যাগের প্রশ্ন ! তৃপ্তিটাই কাম। সুতরাং কাম কখনও ত্যাগ করা যায় না। যে কোন একটি তৃপ্তিতেই কাম হয়ে গেল – সুতরাং ত্যাগ কোথায়? বরং জোর করে ত্যাগ করতে গেলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ারই সম্ভাবনা। তা ছাড়া কাম ত্যাগ করারও প্রয়ােজন নেই। কাম-কাঞ্চন, বিষয় বাসনা ধর্মের অন্তরায়’ – এ ধারণা যে ভ্রান্ত ইতিহাসের নজীর, দেখলেই তা বােঝা যায়। আমাদের দেব-দেবতা, মুনি-ঋষিরা নিশ্চয়ই এ ধারণা পােষণ করতেন না। শিব, কৃষ্ণ, রাম, বুদ্ধ এবং বিরাট বিরাট মুনি ঋষরা যাঁরা বিবাহিত জীবন যাপন করেছেন এবং সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তাদের আধ্যাত্মিক সাধনায় কোন বিঘ্ন ঘটেছে বলে শােনা যায়নি, ইতিহাসও বলে না। সুতরাং কাম ত্যাগের প্রশ্ন উঠেনা, শুধু সমমাত্রায় বাঁধতে হবে। সবটাই থাকবে – শুধু সমতা বজায় রেখে চলতে হবে। এই সমমাত্রা বজায় রাখাটাকেই ব্রহ্মচর্য বলে। নুন ছাড়া যেমন তরকারী বিস্বাদ লাগে, তেমনি কাম না থাকলে সব বিস্বাদ হয়ে যেতাে। মাত্রা মতন যেমন নুন দিতে হয়, কামও তেমনি মাত্রা মতন থাকবে। মাত্রার মধ্যে যেটা থাকবে, সেটা দোষের নয়। গেরুয়া পরে, তিলক কেটে মনকে আটকে রাখতে চায় যাতে মন বাইরে যেতে না পারে। কিন্তু যতই মনের উপর বােঝা চাপিয়ে রাখা যাক না কেন, মন এদিক-ওদিক উকিঝুঁকি মারবেই; এতে যদি আধ্যাত্মিকের কাজ আটাকাতাে, তবে আর কেউ উঠতে পারতাে না। জীবন রক্ষার জন্য কাঞ্চন বা কাঞ্চনমূল্য বিরাট মহানেরা সবাই ব্যবহার করে গেছেন। সুতরাং এই সব সহজাত বৃত্তিগুলি, যা মানুষ কোন দিনই সম্যক ছাড়তে পারে নি, যা জীবনধারণের পক্ষে প্রয়ােজনীয়, কী করে সেগুলি হঠাৎ ধর্মের অন্তরায়, ভগবপ্রাপ্তির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালাে বােঝা। কঠিন।” … ঢাকায় বহু বড় বড় জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতের সমাগম হয়। অনেকে আবার চিন্তা করে যে তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং শাস্তের পারদর্শিতার কাছে এই নবীন যুবক দাঁড়াতে পারবেন না। সেই চিন্তাধারা নিয়ে অনেকে আসে। কিন্তুশেষ পর্যন্ত ঠাকুরের তত্ত্বের কাছে হার মেনে নতি স্বীকার করতে তারা বাধ্য হয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অবতার বলে শ্রীশ্রীঠাকুরকে রামঠাকুর অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু কোনদিন সাক্ষাৎ হয়নি। সুযােগ এসে গেল। রামঠাকুর তখন নারায়ণগঞ্জে কঠিন আমাশয় রােগে ভুগছেন এবং চিকিৎসায় কোন ফল হচ্ছে ঠাকুরও সেই সময় দুই একদিনের জন্য নারায়ণগঞ্জে এসেছেন এবং যে বাড়ীতে উঠেছেন তার পাশের বাড়ীতেই রামঠাকুর আছেন। বালক ঠাকুরকে দেখে রামঠাকুর তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “সত্যনারায়ণ, তুমি এসেছ!” রামঠাকুর ছােটবড় নির্বিশেষে সবাইকে ‘আপনি’ বলে সম্বােধন করতেন। এই ক্ষেত্রেই তার ব্যতিক্রম হল। ঠাকুর যে কয়েকটি নিয়ম-কানুন বলে দিলেন, তাতেই রামঠাকুর সুস্থ হয়ে উঠলেন। এরপর রামঠাকুর তার বহু ভক্তকে ঠাকুরের কাছে দীক্ষা নিতে পাঠাতেন। তিনি নিজে দীক্ষা দিতেন না, নাম দিতেন। | আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে যেমন তার প্রতিপত্তি, তেমনি তার প্রভাব বাস্তব ক্ষেত্রে। প্রচলিত ধর্মের বিকৃত মনােভাবের বিরুদ্ধে, তথাকথিত গুরুমহানদের ধর্মের নামে শােষণের বিরুদ্ধে তার তীব্র প্রতিবাদ শুনেও কেউ তার সঙ্গে প্রকাশ্য বিরােধিতায় নামতে চায় না। কারণ প্রত্যেক কথার মধ্যে তাঁর বলিষ্ঠ যুক্তি, হিন্দু-মুসলমান-খৃষ্টান সকলকেই সমদৃষ্টিতে দেখা মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করে। সবারই ঠাকুরের উপর আশ্চর্য নির্ভরতা। তাই যখন তাঁর এক ভক্ত ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির কর্মচারী, চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য অফিসারদের সঙ্গে কলকাতা যেতে প্রস্তুত হল, ঠাকুর তাকে বলে দিলেন টিকিট ফেরৎ দিতে এবং কলকাতা যাওয়া স্থগিত রাখতে। কারণ ট্রেনে বিপদ আছে। চেয়ারম্যান, অফিসার এবং জানাশুনা সবাইকে জানিয়ে দিতে বললেন। চেয়ারম্যান এবং দুই একজন। অফিসার ঠাকুরের কথার বিশেষ দাম দিল না। অন্যান্য অনেকে যাত্রা স্থগিত রাখলাে। মাঝদিয়ার কাছে এসে ট্রেনে বিরাট অ্যাসিডেন্ট হয় এবং চেয়ারম্যান সমেত অধিকাংশ ট্রেনের যাত্রী মারা গেল। | এই রকম বহু ক্ষেত্রে, আগে থেকে সতর্ক করে দিয়ে অনেককে তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। | ঢাকায় হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গা প্রায় লেগেই থাকতাে। শােনা গেল, সেবার তারা স্বামীবাগ আক্রমণ করে হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। শুধু ঠাকুরবাড়ীকে তারা রক্ষা করবে। এই শুনে ঠাকুরবাড়ীতে আশ্রয়প্রার্থীদের ভীড় লেগে গেল। ঠাকুর দেখলেন যে অসম্ভব অবস্থা। তিনি একাই একটা পাগড়ী মাথায় দিয়ে লাঠি হাতে চলে গেলেন যেখানে মুসলমানেরা জমায়েত হয়েছে। মহম্মদ আলি আর হিমু সর্দারকে ডেকে বললেন এই নিরর্থক অভিযান থেকে নিরস্ত হতে।। ঠাকুর এসেছেন দেখেই তারা বুঝেছিল যে এ যাত্রা তাদের আর আক্রমণ করা। চলবে না। তারা সবাই ঠাকুরকে ভালবাসে এবং পয়গম্বর জ্ঞানে শ্রদ্ধা করে। সুতরাং তিনি যখন এসেছেন, আক্রমণের আর প্রশ্ন ওঠে না। স্বামীবাগ সে যাত্রা বেঁচে গেল। ও ঢাকাতে অবশ্য বেশীদিন থাকা হল না। কারণ স্বাধীনতালাভের সঙ্গে সঙ্গে ই বাংলাদেশ ভাগ হয়ে গেল এবং পূর্ববঙ্গ মুসলমান রাষ্ট্রে পরিণত হল। | ১৯৪৭ সাল। ব্রিটিশরাজ ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গেল ঠিকই, কিন্তু ভারতকে টুকরাে করে দিল। সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হল বাংলা দেশের — পূর্ববঙ্গ হল পাকিস্তান, সম্পূর্ণ আলাদা রাজ্য। ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকলে চলবে না, বিস্তৃত পরিধি নিয়ে তার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তাই ঠাকুর কলকাতায় চলে। এলেন। ঢাকাতে থাকতেই কতকগুলি সম্প্রদায় তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবার চেষ্টায় ছিল, কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারে নি। কলকাতায় আসার পর তারা পূর্ণ উদ্যমে লেগে গেল এবং কিছু অপরিণামদর্শী লােকের সাহায্যে মিথ্যা মামলায় ঠাকুরকে জড়িয়ে সংবাদপত্রের মাধ্যমে অপপ্রচার শুরু করলাে। কিন্তু সত্যসূর্যকে। কখনও মিথ্যার মেঘ দিয়ে চিরকাল ঢেকে রাখা যায় না। অপবাদের মাধ্যমে শ্রীশ্রী ঠাকুরের সর্বত্র প্রচার হয়ে গেল। মানুষ তার আধ্যাত্মিক শক্তির কথা শােনে, অপবাদও শােনে – কৌতূহলী হয়ে দেখতে আসে এই রহস্যময় পুরুষকে — শক্ত হয়ে আসে, ভক্ত হয়ে ফিরে যায়। এই ভাবে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ দীক্ষা নিয়ে যায়। মানুষ অবাক হয়ে শােনে, “পাষাণ আমাদের দেবতা নয়, দেবতা হচ্ছেন নীল আকাশের মত, খোঁজের মাঝে নিখোঁজ হয়ে থাকাই তার পরিচয়। … এমনি খুঁজলে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, সৃষ্টিকে বাদ দিয়ে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। যে কোন বস্তুকে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেই পেয়ে যাবে স্রষ্টার পরিচয়। পেয়ে যাবে আমাদের আবাসের আভাস”। সীমার মাঝে সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছে, সীমা ছাড়িয়ে চিন্তা করবার শক্তি তারা হারিয়ে ফেলেছে। অনেক ধর্ম সম্প্রদয়ই মানুষকে ভুলপথে নিয়ে যাচ্ছে; তাই তিনি সবাইকে সজাগ করে দিয়ে বলছেন, “দেবদেবতা ও পূজাপার্বণের প্রকৃত অর্থ বিস্মৃত হয়ে সবাই সংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে বলেই সমাজ আজ সবদিক থেকে পঙ্গু হয়ে গেছে। সমাজ সংস্কারের চিন্তা করেই দেবদেবতার মূর্তির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পৃথিবীর বুকে স্বর্গরাজ্য গড়ে তােলার জন্যই এদের সৃষ্টি হয়েছিল – পৃথিবীর মানুষকে স্বর্গলােকে নিয়ে যাবার জন্য নয়। তাই তাে এত পূজাপার্বণ, এত যাগযজ্ঞ, এত হৈ চৈতেও দেব দেবতারা আমাদের সামনে আবির্ভূত হন না।” | মানুষ যেমন তার তত্ত্ব শুনছে, তেমনি তার ঐশী শক্তির কথা জানছে — কোনটারই বিরাম নেই। এক ধনী ব্যবসায়ী বিপাকে পড়ে আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু যতবারই সে নিজের দিকে তাক করে রিভলবারের গুলি ছোঁড়ে, কি যেন আটকে যায়। আবার যখন বাইরের দিকে ছোঁড়ে, রিভলবার ঠিক কাজ করে। এমনি করে সব কটা গুলি ফুরিয়ে গেল। উপায়ান্তর না দেখে সে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়বে ঠিক করলাে। গলায় দড়ি পরাতে যাবে, এমন সময় কে যেন এক প্রচণ্ড চড় কষিয়ে দিল – ঘরে কিন্তু কেউ নেই। সে হতভম্ব হয়ে উদ্ভ্রান্তের মত তখনই ঠাকুরের কাছে ছুটলাে। এদিকে ঠাকুর দুটি ছেলেকে বাসষ্টাণ্ডে পাঠিয়ে বলে দিয়েছেন, ‘অমুকে বাস থেকে নামমাত্র ওর কান ধরে নিয়ে আসবি। লােকটি এসে ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চাইলাে। এইভাবে নানা কাজের মধ্যেও প্রত্যেককে তিনি দেখে চলেন। ( ইতিমধ্যে শ্রীশ্রীঠাকুর কিছুদিনের জন্য গয়া গেলেন। সেখানে তিনি কিছুদিন অজ্ঞাতবাস করবেন বলে ঠিক করলেন এবং সেই সময়ে কিছু বই লেখাবেন। কলকাতায়ও মাঝে মাঝে কিছুদিন এখানে ওখানে গিয়ে অজ্ঞাতবাস করেন। গয়াতে কেউ চেনে না। সুতরাং অজ্ঞাতবাসের কোন অসুবিধা হবে না বলেই ভক্তেরা ভাবলাে। কিন্তু কি আশ্চর্য! ষ্টেশনে দু’জন কুলির মনে কি ভাবে জাগলাে যে ইনি মহাপুরুষ! তারা এগিয়ে এসে প্রণাম করলাে। কিছুদিন গয়াতে থাকতে থাকতেই কিছু কিছু লােক দীক্ষা নিতে আসতে সুরু করে। তাদের বেশীর ভাগই স্বপ্নে আদেশ পেয়েছে। আবার স্বপ্নে দীক্ষা পেয়ে বহু লােক দর্শন করতে এসেছে। এমন কি সাধারণ বেশে বুদ্ধ গয়ায় বেড়াতে গেছেন, সেখানে ভিক্ষুরা তাকে দেখেই মহান বলে চিনতে পারে এবং যেখানে সাধারণের যাবার অনুমতি নেই, সেখানে নিয়ে যায়। বােধিবৃক্ষের তলায় গিয়ে ঠাকুর অনেকক্ষণ ধ্যানস্থ অবস্থায় থাকেন। … শেষে এমন অবস্থা দাঁড়ালাে যে, গয়া ছেড়ে মানপুরের একটা পােড়াে বাড়ীতে গিয়ে রইলেন বই লেখাবার জন্য। ১৯১৭ চারিদিক থেকে ভক্তেরা ঠাকুরকে নিয়ে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাে, আবার কলকাতা শহরেও শ্রীশ্রী ঠাকুরের বাণী শােনবার জন্য বিপুল আগ্রহ। সুতরং ঠাকুর কলকাতার আশেপাশে ধর্মসভা করতে শুরু করলেন। ঠাকুরের শ্রীমুখনিঃসৃত বাণী শােনবার জন্য কি বিপুল আগ্রহ – হাজারে হাজারে মানুষ আসে তার মিটিংএ এবং দীক্ষা নিয়ে মন তৃপ্ত করে। বীরভূম জেলা পরিক্রমায় নবসন গ্রামে একদিনেই পচিশ হাজার লােক দীক্ষা নেয় – দূর দূর গ্রাম থেকে গরুর গাড়ী করে তারা এসেছে। ঠাকুর দ্রুত গতিতে তাদের দীক্ষা দিয়ে যান। এত দ্রুত দীক্ষা দেন যে, মিনিটে ষাট সত্তর জনের দীক্ষা হয়ে যায়। মেঠো পথ। দিয়ে হাজারে হাজারে লােক কীর্তন করতে করতে ঠাকুরকে এক গ্রাম থেকে) আর এক গ্রামে নিয়ে যায়। কী সে উন্মাদনা, না দেখলে বােঝা যায় না! নবদ্বীপ। পরিক্রমাতেও একই ঘটনা—সারা শহর ভেঙ্গে পড়েছিল শােভাযাত্রা দেখতে — লােকে লােকারণ্য। রাস্তা দিয়ে গাড়ী তাে দূরের কথা, সইকেল চলারও জায়গা ছিল না। মহাপ্রভুর মন্দিরে এসে ঠাকুর যখন পৌছলেন, মন্দিরের দরজা পুরােহিত খুলতে চায় না ঠাকুরের পরিচয় না পেলে। তিনি যে শ্রীচৈতন্যের অবতার, কুলপঞ্জী বিশ্লেষণ করে যখন জানালেন, পুরােহিত মন্দিরের দরজা খুলে দিল – মহাপ্রভুর গলার মালাটি এনে ঠাকুরকে পরিয়ে দিল। বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ীতেও সে কি সম্বর্ধনা! যেন জামাই এসেছেন শ্বশুরবাড়ীতে। রাণীগঞ্জআসানসােলে যখন পরিক্রমায় গেলেন, সাকতােড়িয়ার এক নামী পরিবার ঠাকুরকে তাদেরও ওখানে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ঠাকুর যে জন্মসিদ্ধ , তা তারা বুঝতে চায়। তাই তাদের ইচ্ছা যে, ঠাকুর একটি টেবিল সাকতােড়িয়ার বাড়ী থেকে মুহূর্তের মধ্যে কলকাতার বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে দেখান যে তিনি জন্মসিদ্ধ। ঠাকুর সাকতােড়িয়াতে গেলেন। কলকাতার বাড়ীতে ফটোগ্রাফার ঠিক করে রাখা হল। নির্দিষ্ট সময়ে ঠাকুর দুটো ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র, একটি বড় শ্বেতপাথরের টেবিল এবং একটি ছােট মেয়েকে শুদ্ধ কলকাতার বাড়ীতে নিয়ে গেলেন সাকতােড়িয়ার ঘর খালি হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার হলঘরটি ভরে গেল। ফটোগ্রাফার আশ্চর্য হয়ে যা চোখের সামনে দেখে, সব ফটো তুলে নেয়। টেলিফোনেও কলকাতা থেকে ফিরিস্তি – কি কি এসেছে এবং মেয়েটি যে এসেছে তাও জানালাে। এর পর পরিবারের সবাই ঠাকুরের শ্রীচরণে, আত্মনিবেদন করলাে। কয়েক বছর ধরেই বহু বিশিষ্ট দার্শনিক, সুরশিল্পী, বৈজ্ঞানিক, বিপ্লবী নেতা আসতে শুরু করেন।ঠাকুর প্রায়ই ক্লাস করেন – বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করেন। কখনও সৃষ্টির রহস্য, কখনও অসীম মহাকাশের কথা, কখনও বা দেহবীণাযন্ত্রে . সুর সাধনার কথা। তারা বিস্ময়াপ্লুত হয়ে ঠাকুরের কথা শােনেন, আশ্চর্য হয়ে ভাবেন “কে এই মহান যিনি সহজ সরল ভাষায় প্রকৃতির রহস্য বলে যাচ্ছেন? তাদের মনে হয় যেন প্রত্যক্ষ ভাবে সবকিছু দেখছেন আর অবিরাম বলে চলেছেন। — “ফঁাকা যে চিরকালই ফঁাকা। তাকে আবার কে সৃষ্টি করবে? তাই অসীম মহাকাশ মহাশূন্য অনন্তকাল ধরে চলে আসছে। তার আদিও নেই, অন্তও নেই। সেই অনন্ত মহাকাশের আজও কেউ সীমা খুঁজে পায়নি। মুহূর্তে যদি লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মাইল বেগে, কোটি কোটি বছর কেউ চলতে পারতাে, তবুও দেখতে পেত যে সে প্রায় একই জায়গায় আছে। “অসীমের সেই অসীমতার কথা স্মরণ করে ভেবে দেখতে হবে যে, এই প্রাণ বা জীবনটা কি এবং কি করে কোথা থেকে আসছে। মহাকাশ থেকে সৃষ্ট জীব মানুষ – সেও চেষ্টা করছে অসীমকে জানতে। ঠিক সেইরকম সেই বিরাট মহাশূন্যও নিজেকে নিজে জানার প্রয়াসে ছুটে চলেছে অনন্তকাল ধরে, সীমাহীন গতিতে। সেই সীমাহীন গতিই হচ্ছে প্রাণ বা চৈতন্য। এই গতি বা চৈতন্যতে ভরা এই মহাকাশ প্রকৃতির মাধ্যমে রূপে রূপে রূপান্তরিত হয়ে, নিজের অনন্ত সত্তার পরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। – “বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে, বিশ্বপ্রকৃতির সৃষ্ট জীব মানুষ সেই একই ধারায়। খুঁজে খুঁজে চলেছে – জানারও শেষ নেই, চাহিদারও শেষ নেই। কোন আশাআকাঙক্ষাই মিটছেনা। আমার আমিত্বের তাড়নায় শুধু ছুটে চলেছে। কিন্তু চাহিদাও মিটছে না, তৃপ্তিও পাচ্ছে না। কে যে নিজের স্বাতন্ত্র্য জাহির করছে, । কে যে বুঝছে, তাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু দেখা যাচ্ছে একটা প্রচণ্ড গতির খেলা। কিন্তু সে তা উপলব্ধি করতে পারছে না। একটি ফুল দেখছে, তাকানাের সাথে সাথে দেখে ফুলটিকে। কিন্তু তাকানাে আর দেখার মাঝে যে মনই বলাে, আর চৈতন্যই বলাে, সমস্ত শিরা উপশিরার ভিতর দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে হাজার হাজার মাইল ঘুরে এল, সে তা উপলব্ধি করতে পারছে না। তার কাছে মনে হয়, দেখা কাজটা মুহুর্তেই হয়ে গেল। একটা চিন্তা থেকে আর একটা চিন্তায় মুহূর্তে চলে যেতে পারছি বলেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব মনে করছি। কিন্তু আমরা একত্বে আছি, যদিও পার্থক্য বলে মনে করি। এত দ্রুতগতিতে আছি। বলেই ভাবতে পারছি না। প্রাণই বল, মনই বল, বুদ্ধি, চৈতন্য বা জ্ঞানই বল – সবটাই একটা গতির ধারা – সর্বত্র বিরাজিত। এই গতিই পরিবর্তনের মাঝে রূপ থেকে রূপান্তরে, কখনও দৃশ্য কখনও অদৃশ্য অবস্থায় নিয়ে চলেছে অনন্ত কাল ধরে। অসীমের অসীমত্ব সেখানেই। প্রাণ, মন, চৈতন্য বা জ্ঞান — কোনটিরই কোন সীমা নেই। সবাই আমরা বিরাট, আবার সেই বিরাটের অসীমতায় এগিয়ে চলেছি আমাদের জানা জিনিষ জেনে জেনে, জ্ঞানের পথে সেই মহাশূন্যের অনন্ত মহাচৈতন্যকে উপলব্ধি করতে করতে।// ই “যে সুরের খেলা বিশ্বপ্রকৃতির ভিতর দিয়ে চলেছে, যে harmony-র সুরে সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে, সেই সুরকে সুরে আনাই হল সাধনা। ভগবান আছেন কি নেই, তা নিয়ে অযথা চিন্তা করার প্রয়ােজন নেই। কর্তব্য ঠিক রেখে যার যার দেহবীণা যন্ত্র অবিরাম বাজালেই তত্ত্বময় হয়ে যাবে। দেহযন্ত্রই সময়ে জানিয়ে দেবে — কোথা থেকে এসেছে, কিসের জন্য এসেছে, কোথায় যাবে।” | ঠাকুরের এক ভক্ত কার্যোপলক্ষে একদিনের জন্য পুরী গেছে। যাবার সময় তার দাদা বলে দিয়েছে নাঙ্গাবাবা বা তােতাপুরীর সঙ্গে দেখা করে আসতে। গিয়ে শুনলাে এই যােগীরই নাকি রামকৃষ্ণদেবের গুরু। আজকাল ইনি কচিৎ দর্শন দেন — তাও ধ্যানস্থ অবস্থায়। হাতে সময় নেই, তাই লাইন উপেক্ষা করে ভক্ত গিয়ে কড়া নাড়লাে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার ডাক পড়লাে। নাঙ্গাবাবা অনেকক্ষণ ধরে ভক্তটিকে দেখলেন, তারপর বললেন “তুমি যে গাছে নৌকা বেঁধেছ, সেই আশ্রয় খুবই শক্ত।… তােমার গুরুর সাথে আমার যােগাযােগ আছে।” পরে এসে ভক্তটি ঠাকুরকে সবকথা জানাতেই ঠাকুর বললেন, “তাের সঙ্গে তাে দেখা করবেই, তুই যে আমার শিষ্য!” নাঙ্গাবাবার বয়স তখন প্রায় আড়াইশাে বছর। বেশ কিছুদিন ধরে মাঝে মাঝে ঠাকুর সমাধিস্থ হয়ে পড়ছেন। ভক্তেরা। উদ্বিগ্ন। এইরকম চলতে চলতে নির্বিকল্প সমাধি হয়ে গেল। পনেরাে দিন যায়, কুড়ি দিন যায় – সমাধি ভাঙে না। ঠাকুরের দরজা দিন রাত খােলা — দিনে রাতে অসংখ্য দর্শনার্থী আসে ঠাকুরকে দর্শন করতে – সাধু-সন্ন্যাসী, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, সংবাদপত্রের প্রতিনিধি প্রভৃতি কেউই বাদ যায় না। পাথরের মত বসে আছেন নিশ্চল, নিস্পন্দ – শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না মৃতবৎ অবস্থা। লক্ষণগুলি পর্যবেক্ষণ করে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা অভিমত দেন যে নির্বিকল্প সমাধির পূর্ণ লক্ষণ তার মধ্যে বিদ্যমান। ভক্তদের মনে ভয় যে, এতদিন হয়ে গেছে – শেষে যদি ঠাকুর দেহত্যাগ করে চলে যান। তাই অনেকে পূর্ণ উদ্যমে কীর্তন করে, আবার কেউ কেউ দিন-রাত্র জপ করে। এই সমাধি অবস্থা চলাকালীন একই সময় বিভিন্ন স্থানে একই ধরণের বিভূতি দেখা যায়। এক নতুন ভক্তের বাড়ী রাত প্রায় দুটোর সময় মিষ্টান্নের বাটি নিয়ে গিয়ে তিনি উপস্থিত। বাড়ীর সবাইকে ডেকে তােলবার আগেই ঠাকুর অন্তর্হিত হন। শুধু মিষ্ঠানের বাটি, আশীর্বাদী ফুল আর খড়ম জোড়া রেখে গেছেন। তখন প্রায় রাত দুটো তখনই সবাই মিলে ঠাকুরবাড়ী রওনা হল। গিয়ে দেখে ঠাকুর নির্বিকল্প সমাধিতে বসা। একই | সময়ে আরও অনেক বাড়ীতে প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছে। তার জ্যোতির্ময় রূপকে তখন কেউ মনে করে দুধের মত শুভ্র, কেউ দেখে নীল। এই ভাবে বাইশ দিন নির্বিকল্প সমাধিতে থেকে যখন সমাধি ভঙ্গ হল খ্রীষ্টমাস-ডে তে, হাজার হাজার মানুষ আসে তাঁকে দর্শন করতে। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মােড় থেকে ঠাকুর বাড়ী পর্যন্ত গাড়ী চলাচলের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। | প্রতিদিন যে কত ঘটনা ঘটে চলেছে, কত শত দুরারােগ্য রােগী যে তার কৃপায় আরােগ্য লাভ করছে, কত দুঃস্থ পরিবার যে তার করুণায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে, কত ভাঙ্গা ঘর যে জোড়া লাগছে তা বলে শেষ করা যায় না। সমাধির পরেই আবার কিছু দিন পরিক্রমায় বের হলেন। অনেক নামকরা সাধক সাধিকা স্বপ্নাদেশ পেয়ে তার চরণাশ্রিত হয়। উত্তরবঙ্গ পরিক্রমায় বহু মানুষ দীক্ষা নেয়। ঠাকুরের ভাষণ শুনে মানুষ মুগ্ধ হয়ে যে ভাবে দীক্ষা প্রহণ করতে ছুটে আসে, তা না দেখলে বােঝা যায় না। চার পাঁচ বছরের শিশু থেকে শুরু করে সত্তর বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত যে ভাবে আকুল হয়ে তার চরণ স্পর্শ করতে চায়, তাঁর আশ্রিত হতে চায়, তার তুলনা মেলা পৃথিবীর ইতিহাসে দুষ্কর। পথে ঘাটে গাড়ী থামিয়ে মানুষ এগিয়ে আসে দীক্ষা নিতে। হয়তাে জীবনে আর তারা ঠাকুরের দর্শন পাবে না, কিন্তু ক্ষণিকের ঐ স্পর্শটুকুকেই তারা জীবনের অবলম্বন করে নেয়। ঐ অশিক্ষিত সরল মানুষরাই বােধ হয় ঠাকুরকে বেশী নিকটে পায়। এর মধ্যে ঘটে যায় আবার কত আশ্চর্য বিভূতি! এইভাবে মানুষের মধ্যে জাগরণের সুর জাগিয়ে তুলে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেন ঠাকুর। তার কাছে সময়-অসময়, শুচি-অশুচি, স্থান-কালের প্রশ্ন নেই, অর্থ-বস্ত্রের কোন প্রয়ােজন নেই শুধু মন-দক্ষিণা নিয়েই লক্ষ-লক্ষ মানুষকে দীক্ষা দিয়ে যান। ” রাসপূর্ণিমা এসে গেছে – কলকাতার বাড়ীতে উৎসব চলছে। হাজারে হাজারে মানুষ আসছে ঠাকুরকে প্রণাম করতে, ভক্তি-অর্ঘ দিতে, দীক্ষা গ্রহণ। করতে। কারণ তাদের অন্য কোন দেবতা নেই, অন্য কোন অনুষ্ঠান নেই – ঠাকুরই তাদের কাছে দেবতা। কেউ তাকে শিবরূপে দেখে, কেউ নারায়ণ রূপে, কেউ বলে খােদাতাল্লার পয়গম্বর, কেউ তাকে পিতা ভাবে, কেউ ভাবে মাতা, কেউ আবার সাধারণ গুরুর মত দেখে – যে যে ভাবেই তাকে দেখে, সেই ভাবেই তিনি সাড়া দেন। এ দিকে রাসপূর্ণিমার দিন ঠাকুরের উড়িষ্যা যাবার কথা, কিন্তু যাওয়া শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলাে না। প্রায় এক মাস পরে উড়িষ্যায় যে ভদ্রলােকের বাড়ীতে ঠাকুরের যাবার কথা ছিল, সেই ভদ্রলােক আরও কয়েকজন গুরুভাইকে নিয়ে উপস্থিত। উচ্ছ্বসিত হয়ে তারা তাদের কৃতজ্ঞতা জানায়। ওদের কথায় জানা গেল যে, ঠাকুর দশবারােজন শিষ্য নিয়ে রাসপূর্ণিমার দিন উড়িষ্যাতে গিয়েছিলেন এবং দশদিন সেখানে ছিলেন। ঠাকুর সেখানে ভাষণ দিয়েছেন, ক্লাশ করেছেন, হাজার হাজার লােককে দীক্ষা দিয়েছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, যে শিষ্যদের ঠাকুর নিয়ে গিয়েছিলেন বলে ওরা বলছে, তাদের খুব অন্তরঙ্গ ভাবে চেনে, কিন্তু ওই শিষ্যেরা কিছুই জানে না, ওদের চেনেও না, অথচ তা মুখ ফুটে বলতেও পারছে না। ঠাকুর যে চিন্ময় দেহে উড়িষ্যা গিয়েছিলেন, সে বিষয়ে তার সন্দেহ থাকে না। এই অণিমা, ব্যাপ্তি, কাম্য প্রভৃতি অষ্টসিদ্ধি ঠাকুরের কাছে অতি সাধারণ ব্যাপার। শিশুবয়স থেকে আজ পর্যন্ত যদি ধরা যায়, তবে কয়েক সহস্র ঘটনা পাওয়া যাবে। কিন্তু এত বড় বিরাট মহাশক্তি নিয়ে যিনি বসে আছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ও ষড়যন্ত্র করতে মানুষের বাধে না। মানুষের অকৃতজ্ঞতা যে কত চরমে উঠতে পারে, তা এই সব ষড়যন্ত্রের কথা বিশ্লেষণ করলেই বােঝা যায়। শৌলমারী সাধুর বিরুদ্ধে জমি আত্মসাৎ করার অভিযােগ তােলা হল – ঠাকুর গেলেন শৌলমারীতে। সাধুকে বিশ্বাসভঙ্গের মামলা থেকে মুক্ত করে যখন কলকাতা এলেন, দেখলেন যে তারই বিরুদ্ধে অনুরূপ একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যাদের খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছেন, তারাই কয়েকজন অকৃতজ্ঞতার চরম নিদর্শন দেখিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে এবং জাল দলিলের সাহায্যে ঠাকুরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। খবরের কাগজগুলিও সত্যমিথ্যা বিচার না করে যতদূর সম্ভব ঠাকুরের নামে অপবাদ ছড়াতে শুরু করলাে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষ কত নীচে নামতে পারে, কত মিথ্যা ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিতে পারে, তা ঠাকুরের বিরুদ্ধে সাজানাে এই মামলা থেকেই বােঝা যাবে। যাই হােক, ঠাকুর ধর্মসভা করে চলেন অবিরাম — সমালােচনায় মুখর হয়ে মানুষ মিটিং এ আসে, তার ভাষণ শুনে অভিভূত হয়ে যায়। মিটিং-এর শেষে প্রায় প্রত্যেকেরই মুখে একই কথা, যেমন সুন্দর সৌম্য চেহারা, তেমনি অপূর্ব তার তত্ত্ব –চল দীক্ষা নিয়ে আসি। ক্রমে দেখা গেল যে, কেউ আর মামলার উপর বেশী গুরুত্ব দেয় না। মানুষ বুঝতে পারে যে, ‘নেতাজী জীবিত আছেন’ –ঠাকুরের এই ধারণাই মূলতঃ স্বার্থান্বেষী এক গােষ্ঠীর বিরাগভাজনের কারণ, আর তার সঙ্গে আছে কিছুসংখ্যক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্ররােচনা। সুতরাং ঠাকুরকে জনসমক্ষে হেয় করবার জন্যই এই প্রচেষ্টা। সেটা আরও ভাল করে বােঝা গেল যখন হাইকোর্ট মিথ্যা অভিযােগ বলে ঠাকুরকে সসম্মানে মুক্তি দিলেন এবং সুপ্রীমকোর্ট বিরােধী পক্ষের আবেদন গ্রাহ্যই করলেন না। কিন্তু সংবাদপত্রগুলি এমনই পক্ষপাতিত্বে ভরা যে, সেই সংবাদগুলি যথাসম্ভব ছােট করে প্রকাশ করে। যাই হােক, একটা সুফল দেখা গেল যে, অপবাদের মাধ্যমে ঠাকুরের নাম চারদিকে ছড়িয়ে গেছে — মানুষ কাতারে কাতারে আসতে শুরু করে চারদিক থেকে, তাকে দর্শন করে, তার ভাষণ শুনে মানুষের ভ্রান্তি দূর হয়, দীক্ষা গ্রহণ করে তারা জীবন সার্থক করে। এইবার ক্রমে সংগঠনের দিকে ঠাকুর মন দেন! ১৯৫৬ সালে যে সন্তানদলের গােড়াপত্তন করেছিলেন, ১৯৬৬ সালে সেই সন্তানদল প্রতিষ্ঠা করলেন। তার সঙ্গে সুরু হল সন্তানদলের মুখপত্র পাক্ষিক পত্রিকা কড়া চাবুক। কড়া চাবুকের মাধ্যমে একদিকে দেশের দুঃসহ পরিস্থিতি, দুর্নীতিপরায়ণ শােষক গােষ্ঠীর অন্যায় অবিচার সম্বন্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানান – দেশের মানুষকে জেগে উঠতে আহ্বান করেন যাতে তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে পারে;আর এক দিকে অপূর্ব আধ্যাত্মিক তত্ত্ব পরিবেশন করে মানুষকে অভিভূত করেন। | এদিকে কত যে অলৌকিক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তার হিসাব রাখা কঠিন। এর মধ্যে একজন নামকরা বিজ্ঞানী এলেন ঠাকুরকে দর্শন করতে। ঠাকুর মিনিট কুড়ি আলাপ করলেন। ভদ্রলােক ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন “ওঁর তাে বিজ্ঞান সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। অতি আধুনিক “টাইম থিওরী”সম্বন্ধে বলে গেলেন। উনি কি করে জানলেন! আমিও সব জানিনা। আজকেই প্রবন্ধটির শুধু সারাংশটুকু পড়েছি। সবটা পড়ার সময় পাইনি।” বলেই ভদ্রলােক বুঝলেন যে ঠাকুরের পক্ষে প্রবন্ধ পড়ে বিজ্ঞান জানার সময়ও নেই, সম্ভবও নয়। তখন তিনি যে কাহিনীটি বললেন তা আরও বিস্ময়কর। – ভদ্রলােকের বয়স তখন দশএগারাে বছর, বেলুড়ে গঙ্গার ঘাটে বসে আছেন। দেখলেন, ঠাকুরের এখনকার চেহারা, কানে কানে একটি মন্ত্র বলে দিয়ে বললেন ‘যখনই বিপদে পড়বি এই মন্ত্রটি স্মরণ করবি। সেই মন্ত্রটি স্মরণ করলেই নাকি ভদ্রলােকের বিপদ কেটে যায়। সেদিন আলাপের মধ্যে নাকি ঠাকুর চারবার সেই মন্ত্রটি বলেছেন। এর পর ভদ্রলােকের আর কোন দ্বিধা রইলাে না – দুদিন পরেই সস্ত্রীক দীক্ষা গ্রহণ করলেন। ভদ্রলােক বয়সে ঠাকুরের থেকে কিছু বড়। ঠাকুরের নাম চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। হাসপাতাল থেকে ফেরৎ রােগী ঠাকুরের স্পর্শে ভাল হয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর বাড়ী থেকে বেশী বের হন না, অথচ বহুলােকে বিভিন্ন জায়গায় তার দর্শন পায়। | একদিন পাম এভেনিউর বাড়ীতে দর্শনের সময়ে একজনকে বললেন, “চল, একটু গঙ্গার ঘাট থেকে ঘুরে আসি কি কি নিয়ে যাব বল।” আগেই গঙ্গার ঘাটে একজন ফটোগ্রাফারকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিষ্যটি উৎসাহ ভরে ঘরে যা যা ছিল প্রায় সবগুলির নাম বললাে। রাত্রে ছবি প্রিন্ট করে নিয়ে আসা হয়েছে। ফটোতে দেখা গেল ঠাকুর গঙ্গার ঘাটে একটি নৌকায় বসে কখনও সেতার, কখনও মৃদঙ্গ বাজাচ্ছেন — ঘরের সব জিনিষ, এমনকি ক্যালেণ্ডারটি পর্যন্ত সাজানাে রয়েছে। শুধু ঘরের জিনিসপত্রই নয়, ছবিতে যে দুজন ঘরে ছিল তাদের মধ্যে একজনকে গঙ্গায় স্নান করতে দেখা যাচ্ছে; আর একজনের শুধু ছায়াটি দেখা যাচ্ছে। ফটোগ্রাফার ঠাকুরকে বাড়ী পৌছে দেবার জন্য ট্যাক্সী ডাকতে কয়েক মিনিটের জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এর মধ্যেই দেখে নৌকাও নেই, ঠাকুরও নেই। এতদিন কীর্তনে নাম তাে “হরে কৃষ্ণ হরে রাম।” এবার ঠাকুর যুগােপযােগীনাম দিলেন “রাম নারায়ণ রাম। সঙ্গে সঙ্গে এই মহানামের ব্যাপক অর্থও বলে দিলেন। “মহাকাশের মহাসুরকে ধ্বনিত করার জন্য মহাকাশ থেকেই সর্গ হিসাবে টেনে এনেছি এই “রাম নারায়ণ রাম।” এই ‘রাম’ বা ‘নারায়ণ’ নাম দিয়ে সেই ত্রেতাযুগের রাম বা সত্যযুগের নারায়ণকে বােঝানাে হচ্ছে না। তিতাে ওষুধ যেমন মিষ্টি কোটিং দিয়ে তৈরী করে, তেমনি ঐ মহাকাশের ওঙ্কার ধ্বনিকে “রাম নারায়ণ” এর মিষ্টি কোটিং দিয়ে তােমাদের হাতে তুলে দিয়েছি রাম (ওঁ) নারায় (ওঁ) ণ (ওঁ) রাম। এই ওঙ্কার ধ্বনি বা প্রণব ধ্বনি থেকেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্ট! জীবজন্তু-গাছপালা কীটপতঙ্গ-মানুষ সকল সৃষ্ট বস্তুর মধ্যেই সেই ওঙ্কার ধ্বনি বিধৃত। সবার মধ্যে সেই সুপ্ত ওঙ্কার ধ্বনিকে জাগ্রত করতে পারলে আজকের সমাজে এই হত্যা-হানাহানি, শােষণ-বঞ্চনার বৃত্তি ঘুচে গিয়ে এক সত্য-সুন্দরের বৃত্তি জেগে উঠবে, প্রেমের জোয়ারে পৃথিবী ভেসে যাবে।” ত একদিকে সন্তানদল, যার উদ্দেশ্য জনগারণ, মানুষকে বেদের আদর্শে, বেদের চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে তােলা, সমাজকে বাস্তবের অভাব অভিযােগ দুর্নীতি ও শােষণ থেকে মুক্ত করে এক পবিত্র পরিবেশ গঠন করা, আর একদিকে মহানাম “রাম নারায়ণ রাম”, যার অবিরাম সংকীর্তনে মানুষের মনে বয়ে যাবে জ্ঞান ও প্রেমের বন্যা — এই দুই নিয়ে বংলাদেশে তথা ভারতে ঠাকুর শুরু করলেন এক নব আলােড়ন। | সন্তানদল একেবারেই নতুন সংগঠন, তবু তাকে তার কর্মনিষ্ঠার পরীক্ষা দিতে হল। যুক্তফ্রন্টের আইন অমান্য আন্দোলন’ – প্রফুল্ল ঘােষ মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে। সন্তানদল রাজনৈতিক দল নয়, তবু ঠাকুর তাদের আন্দোলনে একটা প্রাথমিক পরীক্ষা দিতে বললেন। এখানেও এক আশ্চর্য ঘটনা! কোন প্রস্তুতি নেই, রাজনৈতিক বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ সাধারণ মানুষ কি করে সুশৃঙ্খলভাবে এই আইন অমান্য আন্দোলনে এগিয়ে গিয়ে প্রতিদিন প্রথম পুলিশ কর্ডন ভাঙ্গে, তা চিরকাল বিস্ময়ের বিষয় হয়ে থাকবে! শুধু সংবাদপত্র, জনসাধারণই নয়, প্রতিপক্ষ প্রশাসনও সেদিন সন্তানদলের নিয়মানুবর্তিতা, সুশৃঙ্খল ও শােভন আচরণে মুগ্ধ হয়ে প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠে। এর পরেই পার্কষ্ট্রীটের বাড়ীতে সুরু হল সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাদের আনাগােনা। ঠাকুর স্পষ্টভাষায় বললেন যে, সন্তানদলের কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই, তারা রাজনীতি করে না। তাদের উদ্দেশ্য হল সমাজ থেকে দুর্নীতি ও শােষণ দূর করে পবিত্র সমাজ গঠন করা – তা যার মাধ্যমেই আসুক না কেন। আইন অমান্য আন্দোলনে সমস্ত পার্টির কর্মীদের থেকে সংখ্যায় বেশী হলেও তারা যুক্তফ্রন্টের কোন মিটিংএ যােগদান করেনি। যুক্তফ্রন্টের নেতারা সবসময়ে ফ্রন্টের কর্মসূচী সন্তানদলকে জানিয়ে দিতেন। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রথম সন্তানদলকে সবাই চিনলাে। ঠাকুর জানালেন যে রাজনীতি করা তার উদ্দেশ্য নয়। তবে লেজ নাড়িয়ে বেড়াল যেমন তার বাচ্চাকে শিকার ধরা শেখায়, সেরকমভাবে একটু দেখে নিলেন সন্তানদল কতটা প্রস্তুত। দেখতে দেখতে এলাে উনিশশাে উনসত্তর সালের সাধারণ নির্বাচন। এখানে যে আশ্চর্য ঘটনা ঘটলাে, তা যুক্তফ্রন্টের নেতারাও আশা করতে পারেন নি। নির্বাচনের মাত্র দুই তিন দিন বাকী, ঠাকুর নির্বাচন সম্বন্ধে জনগণের উদ্দেশ্যে কিছু বললেন। ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করা হল, “ঠাকুর, আপনার এই কথা ছেপে বের হতে দ’দিন লাগবে। জনসাধারণ কি করে জানবে আপনার কথা ?” ঠাকর বললেন, “আমি যখন কিছু বলি, যার যার উদ্দেশ্যে বলি, জল-বাতাস-মাটির ভিতর দিয়ে ঈথার তরঙ্গের মত বয়ে গিয়ে তাদের মনে ধাক্কা মারে। তাতেই কাজ হয়ে যায়। ছাপা কাগজটা শুধু উপলক্ষ্য মাত্র।”ভাষণের পরদিন থেকেই খবর আসতে লাগলাে যে হাওয়া পালটে গেছে – যুক্তফ্রন্ট জিতবে। কিন্তু বেশী সংখ্যাগরিষ্ঠতায় যুক্ত ফ্রণ্ট জিতলাে, নেতারা অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু যাঁর কৃপায় জিতলেন, গদীতে বসে তার নির্দেশ মানলেন না। সুতরাং কিছুদিনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন হল। | উত্তর বঙ্গের ভয়াবহ বন্যার সময়ে শ্রী শ্রী ঠাকুরের শিষ্য যে যেখানেই থাকুক না কেন, অদ্ভুত উপায়ে রক্ষা পেয়ে গেছে। বন্যার জল যখন ঢুকতে শুরু করে, তখন প্রায় প্রত্যেকেরই একটা অলৌকিক ঘটনায় ঘুম ভেঙে যায়। কেউ শােনে শ্রী শ্রী ঠাকুরের কণ্ঠস্বর, কেউ স্বপ্নের মাধ্যমে তার নির্দেশ পায়, কারাের উপর বিনা কারণে ঠাকুরের ফটো দেওয়াল থেকে ছিড়ে পড়ে। নিরাপদ স্থানে পৌছান পর্যন্ত তারা প্রত্যেকেই পায় চিন্ময়দেহে শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ দৈবশক্তির পরিচয়। কোথাও হাত ধরে পার করে দিয়েছেন, কোথাও পথ বাতলে দিয়েছেন, কোথাও প্রখর স্রোতের মধ্যে তুলে ধরেছেন, কোথাও বা বন্যার জল বাড়তে দেন নি। মােট কথা, ঠাকুরের সন্তান কেউ প্রাণ হারায় নি। তাছাড়া সন্তনদলও বন্যাক্লিষ্ট জনসাধারণের সাহায্যকল্পে ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের বন্যাত্রাণে এই সময়কার অবদান অতুলনীয়। | শ্যামবাজার থেকে চলে আসার পর রবিবারের ক্লাশ বেশ কিছু দিন বন্ধ ছিল। তারপর আবার শুরু করলেন শিবপুর বি. ই. কলেজে। শনিবার শিবপুরে কয়েকটি ক্লাশ করেই আবার পাম এভিনিউর বাড়ীতেও সেই তত্ত্বের ক্লাশ চলতে থাকে। | ক্লাশে ক্লাশে অবিরাম তিনি বলে চলেছেন যে, মানুষ জন্ম নিয়েছে জানে, মৃত্যু হবে জানে, কিন্তু কোথা থেকে এসেছে, আগে তার অস্তিত্ব ছিল কি না, মৃত্যুর পর কোথায় যাবে, কি হবে – তা তাে মানুষের জানা নেই। মৃতের আত্মার সদ্গতির জন্য শ্রাদ্ধ-শান্তি করছে, কিন্তু আত্মার অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না, সেই সম্বন্ধে কোন ধারণাই নেই। ভগবান বা ঈশ্বর সম্বন্ধে তার কৌতূহল আছে, কিন্তু কয়জনের মনে ভগবান সম্বন্ধে চাহিদা জাগে! মানুষ যদি অশান্তিতে জর্জরিত হয়ে পড়ে, তখন শান্তির খোঁজে একটা অবলম্বন হিসাবে ভগবানের কথা চিন্তা করে। কৈ, ক্ষুধা-তৃষ্ণার মত ভগবানের জন্য তাে চাহিদা জাগে না? তবে একটা জিনিষ মানুষ সব সময়ই চায় — চায় শান্তি এবং সেই শান্তির খোঁজে সে অর্থ উপার্জন করছে, বাড়ী’রছে, ঘর করছে, বাস্তবের যত রকম উপায় আছে সব কিছু খুঁজে খুঁজে দেখছে শান্তি কোথায়। তারপর তাতেও যখন শান্তি পাচ্ছে না, তখন মঠ মন্দিরে ধর্ণা দিচ্ছে। কিন্তু সেখানেও সেই একই চেহারা। পরিবেশের পরিবর্তনে যতটুকু সাময়িক শান্তি। এই শান্তির খোঁজেই মানুষ ভগবানের দ্বারস্থ হয়, কিন্তু সন্ধান তাে কই মেলে না? ঠাকুর তাই সমাধান দিতে গিয়ে বলেন যে, প্রকৃতির মধ্যে একটাই শুধু দেখা যায় – সেটা হচ্ছে। সুরের খেলা। সেই সুরকে সুরে আনতে হলে সাধনার প্রয়ােজন। যেমন স্বরগ্রাম। সাধতে সাধতে সুরজ্ঞ হওয়া যায়, তেমনি অনন্ত বিশ্বের সুরকে সুরে আনতে পারলেই আসবে শান্তি। সেই সুরকে এই দেহবীণাযন্ত্রে বাজাতে হবে — সেই সুরই তখন বলে দেবে কোথা থেকে এসেছ, কেন এসেছ, কোথায় যাবে। সেই জানাতেই পরম শান্তি – চরম পাওয়া। একদিকে যেমন পরম তত্ত্ব দিয়ে চলেছেন, আর একদিকে বাস্তবের পরিস্থিতিতে ব্যথা পেয়ে বলেছেন, দেশের ব্যাপারে চারিদিকে শুধু জল্পনা কল্পনাই চলছে, বাস্তব ক্ষেত্রে কেউ নামছেনা। সবাই শুধু রাজনীতির কথাই চিন্তা করছে, মানব-নীতি তাদের ধারে কাছে ঘেঁসে না। সবাই চাইছে অন্যদলকে নিশ্চিহ্ন করে নিজের দলের অস্তিত্ব বজায় রাখতে। তার ফলে সমাজকে টেনে উন্নতির পথে এগিয়ে না নিয়ে সর্বনাশের পথে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। বলছেন, নিজেদের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি – এটা বীরত্ব নয়, বাহাদুরী নয়, বরং বােকামী। এতে নিজেদের ঘরকেই নষ্ট করা হচ্ছে। এর ফলে বাংলার ভাল ভাল সন্তানরা অকালে চলে যাওয়ায় যুবশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। | বিভিন্ন পার্টির বিভিন্ন ছেলেমেয়েকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে আশ্রয় দিচ্ছেন। কত ছেলেকে যে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে অদ্ভুত উপায়ে রক্ষা করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। একটি ছেলে ঠাকুরবাড়ী আসার পথে রাস্তায় বিপক্ষ দলের সাত-আটটি সশস্ত্র যুবকের আক্রমণে প্রাণ হারাতে বসলাে। ঠিক এমন সময়ে বিরাট শক্তিশালী সাতফুট লম্বা এক হিন্দুস্থানী পালােয়ান এসে আক্রমণকারীদের বগলদাবা করে ফেলে ছেলেটিকে পালিয়ে যেতে বললেন। ছেলেটি পালিয়ে বাঁচলাে। পরে অনেক অনুসন্ধান করেও সেই হিন্দুস্থানী পালােয়ানটির হদিশ খুঁজে পেলনা। প্রায় একই ভাবে অনেক জায়গায় অনেককে বাঁচিয়েছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন মূর্তিতে বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠাকুর ‘কড়া চাবুকের মাধ্যমে অনেক উপদেশ নির্দেশ দেন এক আশ্চর্যভাবে সেইগুলি কার্যকরী করা হয়। আন্তর্জাতিক কোন বাধাই আসে না এবং চারমাসের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পাক সেনাবাহিনীর ব্বর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ঠাকুর বলছেন, ভারতের এখন কোনদিকে না তাকিয়ে, কোন কথায় কান না দিয়ে বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া উচিত — ইয়াহিয়ার ঝড় তােলার পালা শেষ হবে। তার পতন হবে। অন্যায় অসত্য কোনদিন টেকেনি, টিকবে না। (বাঙ্গালীর) পরিণামে জয় হবেই। … এই জন জাগরণের পেছনে আড়াল থেকে অন্য কোন ক্ষমতা কাজ করছে। … যেটা আড়ালে আছে সেটা এখন আড়ালেই থাক।… বাঁচবার জন্য লড়াই যদি রক্ত দিয়ে আসে, তবে তার বিরুদ্ধে যারা যায়, তাদেরই বিনাশ হয়। ইয়াহিয়ারও বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। যাঁরা তখন ঠাকুরের ভাষণ শুনেছেন, তার চালচলন প্রত্যক্ষ করেছেন, তারা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছেন যে সেদিনকার বাঙ্গালীর জয়ের পিছনে ছিল তার আশীর্বাদ এবং পূর্ণ সহযােগিতা। তা না হলে কিছুতেই অল্প সময়ের মধ্যে পাক প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হত না। পরবর্তী নির্বাচনে আবার রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হল। এই পট পরিবর্তনের পরে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিরাট এক বিরােধিতার সূচনা দেখা দিল। বহু নিষ্ঠাবান কর্মী গৃহহারা হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে। কে কী রাজনীতি করে ঠাকুর কখনও জিজ্ঞাসা করেন না — যেই তার কাছে আশ্রয়ের জন্য আসে, তাকেই আশ্রয় দেন, তার রাজনৈতিক মতবাদ তিনি জানতেও চান না। এই ভাবে হাজার হাজার ছেলে, এমন কি পরস্পর বিরােধী পক্ষের ছেলেরাও আশ্রয়ের জন্য আসতে শুরু করলাে। ঠাকুর সবাইকে কোলে টেনে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন। তার কাছে। কর্মের প্রতি নিষ্ঠাটাই বড় কথা – কে কোন পার্টিতে আছে তা নিয়ে তিনি বিচার করেন না। এই একটা আশ্রয়, যেখানে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী পার্টির কর্মীরা এসে একত্রিত হয়েছে। কলকাতা আসার পর প্রায় বিশ বছর কলকাতার বিভিন্ন জায়গায়, বেশীর ভাগই ভাড়াটে বাড়ীতে থেকে শেষ পর্যন্ত গঙ্গার পাড়ে সুখচরে একটি পুরানাে বাড়ী কিনে সংস্কার করে নিলেন এবং ১৯৭২ সালে মহালয়ার দিন এই বাড়ীতে এসে পাকাপাকি ভাবে উঠলেন। এই ভাবে ভক্ত শিষ্যদের বহুদিনের ইচ্ছা পূর্ণ হল। শিষ্য ভক্তদের কাছ থেকে দান গ্রহণ করলে বহুদিন আগেই ঠাকুর বাড়ী করতে পারতেন। কিন্তু কারও কাছ থেকে এক পয়সাও গ্রহণ করা তাঁর নীতিবিরুদ্ধ। ধর্মের নামে অর্থ উপার্জন করা তার নীতিতে খুবই দোষণীয় –সুতরাং অর্থ উপার্জনের জন্য তিনি চাষবাস এবং ছােট ছােট ব্যবসার উপর নির্ভর করেন। অযথা পয়সা খরচ না করে আবাসিক কর্মীবৃন্দের যৌথ প্রচেষ্টার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঠাকুর গড়ে তুললেন সুখচরের এই মনােরম বাড়ীটি। ধর্মসভার বিরাম নেই। মাঝে মাঝে কলকাতার বাইরেও যাচ্ছেন হাজারে হাজারে লক্ষে লক্ষে লােক দীক্ষা নিয়ে চলেছে। বহুদিন ধরে উত্তরবঙ্গ থেকে। অনুরােধ আসছে উত্তরবঙ্গ পরিক্রমার জন্য। ১৯৭৫ সালে দুই মাসের জন্য উত্তরবঙ্গ পরিক্রমায় বের হলেন। প্রায় বারাে বছর পরে উত্তরবঙ্গে গেলেন। সমস্ত উত্তরবঙ্গ ভেঙে পড়লাে—দুমাসে সাড়ে তিন লক্ষ দীক্ষা দিয়ে কলকাতায় ফিরলেন। মানুষের সে কী উন্মাদনা – না দেখলে বােঝা যায় না। রাস্তায় রাস্তায় গাড়ীর সামনে শুয়ে পড়ে গাড়ী আটকায় – ঠাকুরকে তাদের অঞ্চলে যেতেই হবে। এক একটা মিটিংএ এক-দেড় লক্ষ লােক হয় এবং লাইন দিয়ে লােক দীক্ষা নেয়। একটি অন্ধ ছেলের ঠাকুরের স্পর্শে দৃষ্টিলাভ হল, আর একটি বােবা মহিলা বাশক্তি ফিরে পেল। কত অলৌকিক ঘটনা যে ঘটে, তার বিবরণ দেওয়া এখানে সম্ভব নয়। কলকাতায় এসেও বিরাম নেই, ক্রমাগত মিটিং চলতে থাকে। আগে কয়েক জায়গায় মসজিদে সন্তানদলের ছেলেরা কীর্তন করেছে। এবার তারা নাখােদা মসজিদে কীর্তন করবে বলে ইমামের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে নির্দোষ সন্তানদল কর্মীরা হতবাক হয়ে গেল! আমন্ত্রিত হয়ে এসে পুলিশের রােষানলে কেন পড়তে হচ্ছে বুঝতে পারলাে না। পুলিশ শুধু তাদেরই গ্রেপ্তার করলাে না, সুখচর বাড়ীতে হামলা করে অন্যান্য কর্মীদের গ্রেপ্তার করলাে। কর্মীদের বিরুদ্ধে কোন অভিযােগ পেশ রা হয়নি বলে চার-পাঁচ মাস মামলার তারিখ পড়তে পড়তে শেষে সবাইকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হল। তাই | এই বছরেই তারাপীঠের বিখ্যাত তান্ত্রিক শংকর ক্ষেপা তারা-মায়ের আদেশ পেয়ে এসে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। ভীড় ক্রমশঃই বেড়ে চলেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজারে হাজারে মানুষ আসছে দীক্ষা গ্রহরতে। সরল চাষী, গ্রামবাসী বাস-ট্রেন ভর্তি করে দর্শন করতে ও দীক্ষা নিতে আসছে। আবার বুদ্ধিজীবী শ্রেণীরও ভীড় কম নয়। এখানে এমন একটি প্ল্যাটফরম, যেখানে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাই হাজারে হাজারে আসে। এদিকে বহু জায়গা থেকে সংবাদ আসে যে, ঠাকুর তার কয়েকজন ভক্ত-শিষ্যকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন এবং ব্রিাট মিটিং করে এসেছেন এবং হাজার হাজার লােক সেখানে দীক্ষা গ্রহণ করেছে, প্রণাম করেছে—তারাই এসে খবর দিচ্ছে। তারা কিন্তু জানে না যে, এই সময়ে ঠাকুর দুই জায়গায়ই উপস্থিত ছিলেন। এইভাবে বাংলাদেশের কয়েকটি শহরে মিটিং করে এলেন। আবার অনেকে নানাভাবে দর্শন পাচ্ছে। উত্তরবঙ্গে এক জায়গায় স্থানীয় সন্তানদলের একজন বশিষ্ঠ কর্মী একটা জরুরী মিটিং-এ যেতে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। হঠাৎ রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখে একটা খয়েরি রংয়ের গাড়ীতে করে ঠাকুর যাচ্ছেন, গাড়ী একটু থামিয়ে এক ভক্তকে দর্শন দেন। হঠাৎ রাস্তার মাঝে ঠাকুরকে প্রণাম করবার সুযােগ পেয়ে সে ভীষণ খুশী। কিন্তু বাস্তব মানে দেখতে গেলে এই দুইদিনের একদিনও ঠাকুর সুখচর বাড়ী থেকে বের হননি। এই ভাবে বহু জায়গায় চিন্ময়দেহে তার আবির্ভাবের কথা শােনা যায়। | আমরা হয়তাে পরম রত্ন কাছে পেয়েও চিনতে পারি না, বুঝতে পারি না। কিন্তু জহুরী তাে জহর চেনে। তাই হয়তাে আমাদের দৃষ্টিশক্তি খুলে দেবার জন্য বহুজন পূজ্য ঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথজী তার মহাপ্রয়াণের কিছুদিন পূর্বে শ্রীশ্রী ঠাকুরের দর্শনলাভের জন্য আকুল আহ্বান জানান। তাঁর দর্শনে মুগ্ধ হয়ে বলে ওঠেন, “নারায়ণ!তুমি এসেছ!’ শােনা যায় ভক্তদের জানান, “নারায়ণ। আর কোথাও নেই, শালগ্রাম শিলাতেও নেই, মঠে-মন্দিরে-বিগ্রহেও নেই, নারায়ণ যদি দেখতে চাও, সুখচর ধামে যাও।” | সূফী সাধক মােহম্মদ ইয়াকুব চিস্তি তাে শ্রীশ্রী ঠাকুরের মধ্যে দেখতে পান। পবিত্র কোরআন শরীফে বর্ণিত “রসূলে অর” বা “আলেমুল গায়েবে”। তিনিই স্বয়ং “নূর উস্ সামাওয়াতে আল্ আরদে”এবং“আল্লাহ রাব্লু সামাওয়াতে আল্ অরদে।”তার দেওয়া নাম “রামনারায়ণ রাম”এমনই এক “ইসমে আজম্” যাতে সব “খাদিম”,“তাজকিয়া” এবং “লা মােকাম” আছে সুরে গাঁথা। এত শুনেও কি সংস্কারান্ধ মানুষ এই পরম জ্যোতিকে জানবার, উপলব্ধি করবার চেষ্টা করে?তাহলে তাে দেশে অনেক দিন আগেই শান্তি ফিরে আসতাে! যে মহানের কাছে কামধেনু মাতা আসেন, তিনি যে সাধারণ নন, তিনি যে বিরাট ঐশীশক্তি সম্পন্ন, তার প্রমাণ তাে আমাদের শাস্ত্রেই আছে। | এদিকে সন্তানদলের অগ্রগতি প্রচণ্ডভাবে এগিয়ে চলেছে – সবাই কাজ করবার জন্য ব্যাকুল, প্রচার করবার জন্য ব্যস্ত। ট্রাকে, ট্রেনে, বাসে, হাজারে হাজারে লোেক আসছে দীক্ষা নেওয়ার জন্য। ঠাকুরের আর বিশ্রাম নেই — অবিরাম দর্শ-দীক্ষা দিয়ে চলেছেন। অন্যান্য গুরু-মহানদের মত দূর থেকে যদি দর্শন দিতেন, তবে তাে কোন প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু ঠাকুর যে একাধারে মাতা, পিতা, বন্ধু, গুরু এবং ভগবান। সুতরাং চরণ-স্পর্শ তাে করবেই। তা ছাড়া কেউ জড়িয়ে ধরছে, কেউ বুকে মাথা রেখে সান্ত্বনা খুঁজছে। একসঙ্গে চার-পাঁচজন এইভাবে গায়ের উপর যদি পড়ে, তবে সাধারণ মানুষ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে, ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়বে। কিন্তু ঠাকুর নির্বিকার, হাসিমুখে সবার সঙ্গে কথা বলে চলেছেন। এদিকে সন্তানদলের প্রচার চলছে পুরাে উদ্যমে। যদিও ইমারজেন্সীর সময় ‘কড়া চাবুক’ এর প্রকাশনা বন্ধ রাখতে হয়েছিল, কিন্তু ধর্মসভা অবিরাম করে গেছেন। সুতরাং সন্তানদলের জনবল যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি মহানাম “রাম নারায়ণ রাম” এর বন্যা বয়ে যায়। কখনও কখনও কোন কোন স্থানীয় রাজনৈতিক পার্টি সন্তানদলের মহৎ উদ্দেশ্যের কথা বঝতে না পেরে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সন্তানদলের অগ্রগতি অব্যাহত থাকে। কারণ অসীম ধৈর্য ও স্থৈর্যের সাথে তারা কাজ করে চলে। | ঠাকুর সবাইকে বলে চলেন যে দেশকে, জাতিকে বাঁচাতে হলে চাই এক বৈপ্লবিক জাগরণ – যাতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, সমাজের সব উঁচু নীচু দূরীভূত হয়ে এক সমতার সুরে সমাজ গড়ে উঠবে। দ্বন্দ্ব-দ্বিধা, হিংসাদ্বেষহীন সেই নতুন সমাজে প্রকৃতির সুর আপনি বেজে উঠবে – কি আধ্যাত্মিক, কি বাস্তব কোন সমস্যাই তখন সমস্যা থাকবে না। কিন্তু বিপ্লব ছাড়া পরিবর্তন হবে না। তবে সেটা রাজনৈতিক বিপ্লব নয়, বেদের বিপ্লব – যা একদিন এ দেশেরই মানুষ করে গেছেন। কী সেই বিপ্লবের রূপ? কোন ধারায় সেই বিপ্লব আসবে? কবে আসবে? – এ প্রশ্ন মনে আসা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন ব্যক্তির পক্ষেই এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লবের পূর্বাহ্নে কেউ এই প্রশ্নের জবাব দিতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। একটা মােটামুটি ইঙ্গিত হয়তাে দিতে পারে, কিন্তু বিপ্লব কোন ধারায় বইবে, কখন আসবে, এটা বােধ হয় কেউ আগে থেকে সঠিক বলতে পারে না। ঠাকুরের কেয়কটি কথা এই বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়—অঙ্কের ফল এক না হওয়া পর্যন্ত মারামারি, কাটাকাটি চলবে, ‘প্রত্যেকের মধ্যেই নেতৃত্বের বীজ আছে, প্রত্যেকেই নেতা হতে পারে’, ‘সন্তানদল কোন দল নয়, পৃথিবীর প্রতিটি সন্তান নিয়েই এই দল। তিনি বেদের বিপ্লবের কথা বলছেন, আবার বলছেন, প্রকৃতিই বেদ’, সুতরাং সে প্রকৃতিরই বিপ্লব। বলেছেন, “প্রলয়ের ডমরু ধ্বনিতে প্রাকৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে বর্তমান সমাজের যত অন্যায় অত্যাচার দূর করে আনতে হবে আমূল পরিবর্তন। এই ধ্বংসের মাঝে — ধ্বংসস্থূপের মাঝেই অঙ্কুরিত হবেনবরূপে সৃষ্টির বীজ। তখন সর্বত্রই থাকবে সমতার ধারা, সমতার সুর, স্বচ্ছতার সুর। আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষলতা সবকিছুই যেন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠবে। পুরাতনের কোন গ্লানি, কোন বিচ্ছেদের চিহ্ন থাকবে না সেখানে।”তাই মনে হয়, মানুষ যে বিপ্লব শুরু করবে বিরাট ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠে, প্রকৃতিই সেই বিপ্লব শেষ করবে। তারপরই শুরু হবে নব সৃষ্টি |

বুধবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২২

বালক ব্রহ্মচারী মহারাজ কার ধ্যান করেন

#প্রশ্ন: শ্রীশ্রী ঠাকুর কার ধ্যান করেন..? #উত্তর- জন্মসিদ্ধ ঠাকুর শ্রীশ্রী বালক ব্রহ্মচারী মহারাজ 'শূন্যে'র ধ্যান করেন। স্রষ্টার স্বরূপ সত্তা শূন্যসত্তা। পরম চৈতন্যময় মহাশূন্য মহাকাশ থেকেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছু সৃষ্টি। শ্রীশ্রী ঠাকুরের স্বরূপ সত্তাও সেই চৈতন্যময় শূন্যসত্তা। তাই সেই শূন্যের ধ্যানেই তিনি আত্মস্থ--'হরি হয়ে হরি ভজে গৌর নিত্যানন্দ'। শ্রীশ্রী ঠাকুর বিভূতি দেখাবার জন্য দেখাতেন না--স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রকাশ হয়ে যেত। শৈশবে ও বাল্যকালে এই ঘটনা অহরহ ঘটত। পরবর্তীকালে সংহত আকারে প্রকাশ পেত। ব্যাটারী অতিমাত্রায় চার্জ হয়ে গেলে আপনা থেকেই 'স্পার্ক' করে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে তা বন্ধ থাকে। অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে বৃহৎ স্বার্থে--ব্যাপ্তির প্রয়োজনে কোন কোন সময়ে স্বেচ্ছায় বিভূতি শক্তির প্রকাশ ঘটাতেন। Ram Narayan Ram